পর্ব ১৬

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

উপাধ্যায়ন্‌ দশাচার্য আচার্যানাং শতং পিতা।
সহস্রন্তু পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে।।
—মনুসংহিতা [২.১৪৫]

       অর্থাৎ দশজন উপাধ্যায় (যিনি বেতন নিয়ে আংশিক বেদ পড়ান) অপেক্ষা একজন আচার্য (যিনি সম্পূর্ণ বেদ পড়ান) - এর গৌরব বেশি। একশো আচার্যের থেকে জন্মদাতা পিতার গৌরব অধিক। আবার সহস্র পিতা অপেক্ষা মায়ের গৌরব অনেক।
         মনু নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছেন মা হিসাবে। মানবসভ্যতা সৃষ্টির পর থেকে এখনও পর্যন্ত এই আসন অটুট। মনু আরও বলেছেন, সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে বংশ রক্ষা করার জন্য স্ত্রী গণ মাতার স্থান অধিকার করেন। তাই তাঁরা সকলের পূজ্যা। কিন্তু আক্ষেপের বিষয়, শুধুমাত্র ‘মা’ হিসাবে নারী যেটুকু আদর পান, আর কোন ভূমিকাতে তাঁরা তাদের যোগ্য কদর পান না। 
        কন্যাকে তো একদিন পরের বাড়ি যেতেই হবে; তাই তার ওপর বেশি বিনিয়োগ করার দরকার নেই। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে সাধারণ পরিবারে কন্যা সন্তানের থেকে পুত্র সন্তান বেশি পুষ্টিকর খাদ্য পায়। শুধু তাই নয়, ছেলেদের শিক্ষার ব্যাপারে অভিভাবকেরা যতটা সচেতন; মেয়েদের ব্যাপারে ততটা নয়। হিন্দি বলয়ে যেমন বলা হয়, “লেড়কি তো হ্যায় পরায়া ধন।”মেয়েদের সংসার ঠেলতে হবে, তাই রান্না, ঘরকন্না শিখলেই হল। চাকরি করে স্বাবলম্বী না হলেও চলবে। 

বিয়ের পর মেয়েরা সংসারের হাল ধরলেও সংসারের মূল রাশ অর্থাৎ আর্থিক ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার বাড়ির কর্তার কাছেই থাকে। মা হিসাবে সম্মান পেলেও মাকে সন্তানের ইচ্ছার অধীনেই থাকতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মায়ের কোনও আয় থাকে না, তাই তাদের ভরণপোষণের জন্য সন্তানের গলগ্রহ হয়ে থাকতে হয়।
মেয়েদের একক ভাবে কোনও সামাজিক পরিচয় নেই। কথাটা দুঃখের হলেও সত্যি। আজও আমরা যেসব মহিলাকে সাফল্যের চূড়ায় দেখি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাঁর পিছনে আছে পারিবারিক প্রেক্ষাপট বা স্বামীর সাফল্য। বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এটা বেশি চোখে পড়ে। ১৯৬০ সালে আধুনিক বিশ্বে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হন শ্রীলঙ্কায় সিরিমাভো বন্দরনায়েক। তার আগে তাঁর স্বামী সলোমান বন্দরনায়েক শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ব্যতিক্রম বলা যেতে পারে। কোনও সফল রাজনৈতিক গুরু ছাড়া এবং পারিবারিক পটভূমি ছাড়া একটি রাজ্যের ক্ষমতার শীর্ষে আসতে পেরেছেন।


মেয়েদের সামাজিক পরিচয় তার স্বামীর পরিচয়। বৈদিক যুগে একাকী নারী স্বাভাবিক ভাবে তার জীবন ধারণ করলেও পরবর্তীকালে এমন সামাজিক পরিস্থিতি তৈরি করা হল যে, নারীদের বিবাহ করা ছাড়া যেন আর কোনও ভবিতব্য নেই। মনু বললেন, নদী যেমন সমুদ্র মিলনে লবণাম্বু হয়, নারীও তেমন। যখন পুরুষের সাথে বিবাহিত হয়, তখন গুণযুক্ত হয়।
মহাভারতে সভরূ ঋষির কন্যা চিরকুমারী ছিল। তিনি ধর্ম-কর্ম, বিদ্যাচর্চা নিয়ে থাকতেন। মৃত্যু শয্যায় জানতে পারলেন যে তিনি সারা জীবন ধর্ম পালন করেও স্বর্গে যেতে পারবেন না। কারণ, বিবাহের দ্বারা তার দেহ পবিত্র হয়নি। বিয়ের আগে মেয়েদের সামাজিক পরিচয় তার পিতার বংশপরিচয়। বিয়ের পর সেই বংশ পরিচয় কেউ মনে রাখে না। তখন তার সামাজিক পরিচয় স্বামীর বংশপরিচয়। “কাদের কূলের বউ গো তুমি, কাদের কূলের বউ?” বিবাহের আগে নারীর ব্যক্তিগত মূল্য তার রূপ ও যৌবন। বিবাহের পর তার মূল্য বংশবদতা ও সেবাপরায়নতায়।


বিজ্ঞতা, দক্ষতার দিক থেকে নারী, পুরুষ সমান শুধু তাই নয়; জননী হিসাবে নারী আরও অনেক গুণের অধিকারিনী। এই জন্য পুরুষের থেকে নারী বহুগুণে উন্নততর। শুধু তাই নয়, বাস্তব জগতে দেখা যায় শিশুকন্যা, শিশুপুত্রের চেয়ে আগে সবকিছু শেখে। একই বয়সের ছেলের থেকে মেয়েরা অনেক বেশি পূর্ণমনস্ক। যার জন্য বিবাহের ক্ষেত্রে মেয়ের বয়স কম এবং ছেলের বয়স বেশি থাকা বাঞ্ছনীয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এই ব্যবস্থাটাকে নিজেদের মতো করে বানিয়ে নিয়েছে। কনেকে নাবালিকা রেখে আনুপাতিক ভাবে বরের বয়স অনেক বাড়িয়ে নিয়েছে; যার নিদান মনুসংহিতাতে পাই। বেশি বয়সের স্বামী হলে কম বয়সের স্ত্রীর ওপর আধিপত্য করতে সুবিধা। ভারতে অনাদিকাল থেকে নারী পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের মূলকেন্দ্র। কিন্তু পুরুষরা গায়ের জোরে এই সত্যগুলোকে অস্বীকার করেছে।
এই সত্যকে উপলব্ধি করে উনবিংশ শতাব্দীতে কিছু পুরুষ নারীর পক্ষ নিয়ে লড়াই করেছেন। যার মধ্যে রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান সকলের জানা। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, তারপরেও দুশো বছর হতে চলল এখনও পর্যন্ত নারীদের সামাজিক অবস্থান যে জায়গায় থাকার কথা, সেই জায়গায় আসেনি।
এই সামাজিক অবস্থান নারীকে ঠেলে দিয়েছে অন্ধকারের পঙ্কিল গহ্বরে, পরিপুষ্ট হয়েছে নারীপাচারের পরিকাঠামো।

তথ্য ঋণ:
১. মনুসংহিতা- সম্পাদনা ও ভাষান্তর- চৈতালী দত্ত- নবপত্র প্রকাশন।
২. নারী – হুমায়ুন আজাদ (আগামী প্রকাশনী, বাংলাদেশ)।