[নবম পর্ব]
(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)
“একজন ছেলেকে শিক্ষা দিলে, একজন ব্যক্তি শিক্ষিত হয়। আর একজন মেয়েকে শিক্ষা দিলে, গোটা পরিবার শিক্ষিত হয়।” আফ্রিকান প্রবাদ।
এই প্রবাদের মধ্য দিয়ে দেখতে পাচ্ছি নারী শিক্ষার গুরুত্ব। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনওদিন নারীদের শিক্ষার ব্যাপারটি সমাজ গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। বলতে আপত্তি নেই এখনও সেভাবে সমাজে বিষয়টি অগ্রাধিকার পায় না। না হলে মেয়েদের স্কুলমুখী করতে এত প্রকল্প, নানা অনুদান!
তবে অতীত ভারতে, বিশেষত বৈদিক যুগে মেয়েদের শিক্ষার জগৎ তুলনামূলক উজ্জ্বল ছিল। শিক্ষার আঙিনায় পুরুষদের সঙ্গে সমান অধিকার ছিল। অন্যান্য সামাজিক ব্যাপারে পিছিয়ে থাকলেও শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীরা প্রাধান্য পেত। ঋকবেদে অপালা, ঘোষা, গোধা, বিশ্ববারা প্রমুখ ২৭ জন ব্রহ্মবাদিনী – ব্রহ্মদ্রষ্টী নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়। উপনিষদে পাই গার্গী ও মৈত্রেয়ীর নাম।
“যে পার্থিব ধনের দ্বারা অমৃতত্ত্ব লাভ করা যায় না, সেই ধন দিয়ে আমার কী কাজ হবে?” এই সারস্বত উক্তি মৈত্রেয়ীর। ভাবতে ভাল লাগে, কী উন্নত ছিল সে যুগে মহিলাদের চিন্তাধারা। বৈদিক যুগে পুরুষদের সঙ্গে নারীদেরও উপনয়ন, ব্রহ্মচর্য, দীক্ষা গ্রহণ, বেদ পাঠের অধিকার সমান ভাবে ছিল। মেয়েরা ছেলেদের মতো গুরুগৃহে থেকে বিদ্যাচর্চা করতো এবং শিক্ষাগুরুর জন্য ভিক্ষাচর্যা করতো। বৈদিক পরবর্তী যুগে মেয়েদের শিক্ষার জগৎটা সংকুচিত হয়ে গেল। বৈদিক যুগের পর এলো স্মৃতির যুগ। স্মৃতিগ্রন্থ ‘যমসংহিতা’য় উল্লেখ আছে পিতা, পিতৃব্য বা ভ্রাতা ব্যতীত অন্য কেউ নারীদের অধ্যাপনা করবে না। কন্যার ভিক্ষাচর্যাও নিজের (পিতৃ) গৃহে হবে।
রামায়ণ, মহাভারতে অনেক বিদুষী নারী ও ঋষি নারীর উল্লেখ পাই। রামায়ণে কৌশলা, সীতা, তারা (বালির পত্নী) প্রত্যেকেই ছিলেন বৈদিক সাহিত্য ও বিবিধ শাস্ত্রে পারদর্শী। উত্তর রামচরিতে আত্রেয়ী নামে এক ছাত্রীর নাম পাওয়া যায়, যিনি লব-কুশের সঙ্গে বাল্মিকীর আশ্রমে থেকে বিদ্যালাভ করতেন। মহাভারতে দ্রৌপদী, অরুন্ধতী (মহর্ষি বশিষ্টের পত্নী), উত্তরা (অভিমন্যুর স্ত্রী), মাধবী (যযাতির কন্যা) প্রভৃতি প্রত্যেকে ছিলেন বিদুষী। উত্তরা স্বগৃহে সকল বিদ্যাশিক্ষা লাভ করেছিলেন। রামায়ণে ঋষি নারী ছিলেন পম্পা সরোবর তীরে শবরী। মহাভারতে ঋষি নারী ‘শিবা’ ছিলেন সর্ববেদ পারদর্শিনী ব্রহ্মবাদিনী।
স্মৃতির যুগ শুরু হতে সমাজে নারীদের মর্যাদা ক্রমশ ক্ষুন্ন হতে আরম্ভ করে। তাদের বৈদিক শিক্ষা গ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হল। স্মৃতিশাস্ত্রের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ ‘মনুসংহিতা’তে বলা হল – “সন্তান উৎপাদন, সন্তানের প্রতিপালন, অতিথি সৎকার এবং অন্যান্য সাংসারিক কাজ সুষ্ঠভাবে সম্পাদনের মাধ্যমেই স্ত্রীজাতির জীবন সার্থক হয়।” তিনি আরও বললেন, “সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে বংশ রক্ষা করার জন্য স্ত্রীগণ মাতার স্থান অধিকার করেন। তাই তারা সকলের পূজ্যা।”
মনুর মতে, “যেখানে স্ত্রীজাতি পূজিতা, সেখানে দেবতারা খুশি হন, যেখানে নারীদের পূজা নেই, সেখানে সকল ধর্মকর্ম নিষ্ফল।”
যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে
রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যেত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।।
মনু নারীদের পূজা করার কথা বললেন বটে, কিন্তু শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিলেন; স্বাধীনতা হরণ করলেন। সেই তমসা কাটতে লেগে গেল বিংশশতাব্দী। মুসলিম শাসনাধীনে মহিলারা আরও বেশি গৃহবন্দী হয়ে পড়লেন, পর্দানসীন হলেন। ব্রিটিশ শাসনাধীনে প্রথম ১০০ বছর একই অবস্থা চলেছিল। মেয়েদের বিদ্যাচর্চা ছিল ঘোরতর গর্হিত কাজ। বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথাতো কেউ কল্পনাও করতে পারতো না। উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় নবজাগরণের সময় কিছু ভারতীয় মনীষীর মনে উদয় হয় নারী শিক্ষা ছাড়া সমাজের সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। এ বিষয়ে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা তো ঈশ্বরতুল্য। ভারতীয়দের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক দূরীভূত করার জন্য ইউরোপীয়দের অবদান কম ছিল না। ‘বেথুন’ সাহেবের কথা কে না জানে; পরবর্তীকালে ভগিনী নিবেদিতা।
কাউকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা মানে, তাকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। মেয়েদের প্রায় দুহাজার বছর শিক্ষার আলো থেকে দূরে রেখে বোঝানো হয়েছিল, ঘরের আলো-আধাঁরি পরিবেশই তাদের জন্য নিরাপদ জগৎ। বাইরের জগতে শত বিপদ, হাজার ভয়। বর্হিজগতে মেয়েদের অনেক কিছু করার আছে, তা তাদের ধারণার অতীত ছিল। তাঁরা ভাবতো ঘরের বাইরে মেয়েদের একমাত্র স্থান গণিকালয়। বিশ্বের কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে গেলে যে সামান্য জ্ঞানের প্রয়োজন, তা তখনকার মেয়েদের ছিল না। তাই যদি কেউ পরিবারের ঘেরাটোপের বাইরে পা রাখত, তাকেও সেই বারাঙ্গনাদের দলে নাম লেখাতে হতো। সেখানে গিয়ে সে অনেক কিছু শিখতো বটে, কিন্তু সেটা তার পেশা চালানোর জন্য। তাই তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থা নারীদের বিকল্প কোন পেশা গ্রহণ করতে সাহায্য করেনি। তাই বলা যেতে পারে “নারী শিক্ষা হীনতা” নারীপাচারের পথকে সুগম করেছে।
তথ্যসূত্র:
১. মনুসংহিতা- সম্পাদনা ও ভাষান্তর- চৈতালী দত্ত নবপত্র প্রকাশন।
২. পৌরাণিক অভিধান- সুধীরচন্দ্র সরকার।
৩. মহীয়সী ভারতীয় নারী- সম্পাঃ স্বামী মাধব চন্দ্র, ডঃ রমেশচন্দ্র সরকার, উদ্বোধন কার্যালয়।
very nice story