পর্ব ৪
আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারীপাচার নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।
বৈদিক যুগ থেকেই নারী ভোগ্যবস্তু হিসাবে পরিচিতি পেয়ে যায়। ভোগ্যবস্তু মানেই পণ্য। যা পণ্য, তা বিপণন হবে। যে পণ্য বিক্রি হবে, আগে তা সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু নারী তো আর গাছের ফল বা জমির ফসল নয় যে উৎপাদন করে নিলাম; মানব সম্পদ। তাই এই সম্পদ সংগ্রহ করার জন্য হরণ করা ছাড়া উপায় নেই। অর্থাৎ বল প্রয়োগ করতে হবে। আর নয়তো প্রলোভন দেখিয়ে বাগে আনতে হবে। হরণ করার নিদর্শন ঋক বেদের যুগেও ছিল। যেমন পুরমিত্রের কন্যাকে হরণ করেছিলেন বিমদ। বিবাহের জন্য বা প্রণয় ঘটিত কারণে নারীর ইচ্ছাক্রমে বা অনিচ্ছাক্রমে নারী হরণ অপরাধ বলে গণ্য হতো না।
হিন্দুশাস্ত্রে আট রকম বিবাহ পদ্ধতির কথা বলা আছে। যথা- ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজপত্য, গান্ধর্ব, আসুর, রাক্ষস ও পৈশাচ। রাক্ষস ও পৈশাচ বিবাহে হরণ কার্যটি সরাসরি যুক্ত। পাত্রীকে তার অভিভাবকের হেফাজত থেকে জোরপূর্বক হরণ করে বিয়ে করার নাম রাক্ষস বিবাহ। পাত্রীর এতে মত থাকতে পারে নাও থাকতে পারে। শ্রীকৃষ্ণ তার প্রথমা স্ত্রী রুক্মিণীকে বিবাহ করেছিলেন হরণ করে, যার জন্য তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণের বোন সুভদ্রাকে হরণ করেছিল অর্জুন, তাতে সুভদ্রার মত ছিল না, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের মত ছিল। পৈশাচ বিবাহ সবথেকে নিকৃষ্ট। এটি ঘুমন্ত, মত্ত, প্রমত্ত নারীকে নির্জনে নিয়ে সম্ভোগ করে বিবাহ। বর্তমান আইন অনুসারে এ ধর্ষণের সামিল।
ইতিহাসেও রাক্ষস বিবাহের উদাহরণ আছে। সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল রাক্ষস বিবাহের উদাহরণ হল পৃথ্বীরাজ ও সংযুক্তার বিবাহ। হরণ ও অপহরণ দু’টি শব্দ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়। তবে হরণ ও অপহরণের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। হরণ মানে চুরি, লুন্ঠন, বলপূর্বক গ্রহণ। এক্ষেত্রে সরাসরি বল প্রয়োগের শর্ত আছে। অপহরণের ক্ষেত্রে সরাসরি বলপ্রয়োগ নাও হতে পারে; অন্যায় ভাবে, চাতুরি করে অর্থাৎ অপকৃষ্ট ভাবে গ্রহণ করাকে বলে অপহরণ। বর্তমান কালের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কোনও মহিলা বা শিশুকে জোর করে দুষ্কৃতীরা ধরে নিয়ে গেল। একে আমরা হরণ বলতে পারি। কোনও একটি নাবালিকা মেয়েকে প্রেম ঘটিত কারণে বা অন্য কোনও ব্যক্তিকে ছল চাতুরি করে কোথাও নিয়ে গেল। এক্ষেত্রে অপহরণ বলতে পারি। নাবালিকা কন্যা ভাব-ভালবাসা করে পালালে সেটিকেও আইনি ভাষায় ‘হিউম্যান ট্রাফিকিং’ বা মানবপাচার হিসাবে ধরা হয়। তবে আমাদের আলোচনা থেকে এই ধরনের ঘটনাগুলিকে বাদ রাখবো। তবে একটা কথা জানিয়ে রাখি আমাদের বাংলায় যত নারীপাচার কেস হয়, তার সিংহভাগ এই ধরনের ঘটনা।
ভারতীয় সাহিত্যে অপহরণের প্রথম উল্লেখ বলা যেতে পারে রামায়ণের ‘সীতাহরণ’। রাবণকে এজন্য ছল-চাতুরির আশ্রয় নিতে হয়েছিল, মরীচকে মায়ামৃগ সাজতে হয়েছিল, নিজে সাধুর ভেক নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে হরিবংশে পাই নরকাসুর ষোলহাজার কন্যাকে হরণ করে প্রাসাদে আটকে রেখেছিলেন। নরকাসুর ছিলেন প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা। প্রাগজ্যোতিষপুর বর্তমানে ভারতের অসম রাজ্য। অতীতে প্রাগজ্যোতিষপুর বৃহৎ বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল। নরক কৃষ্ণের দেবত্বে বিশ্বাস করতেন না। নরক একবার হাতির রূপ ধরে বিশ্বকর্মার কন্যাকে অপহরণ করে সতীত্ব নষ্ট করেন। পরে তিনি গন্ধর্ব, মানুষ ও দেবতাদের কন্যাদের হরণ করে সুন্দর অট্টালিকার মধ্যে বন্দি রেখেছিলেন। নরক দেবমাতা অদিতির কর্ণকুন্ডল চুরি করে। অবশেষে কৃষ্ণ নরককে বধ করে কর্ণকুন্ডল এবং ষোলহাজার কন্যাকে উদ্ধার করেন। এই কন্যাদের অনুরোধে কৃষ্ণ তাদের গ্রহণ করেন অর্থাৎ বিবাহ করেন। কৃষ্ণের সব শুদ্ধ ষোলো হাজার একশত আটজন পত্নী ছিল।
ইতিহাসে এক বাঙালি অপহরণকারীকে পাই। তিনি হলেন বাংলার প্রথম ঐতিহাসিক স্বাধীন সম্রাট শশাঙ্ক। গৌড় অধিপতি শশাঙ্ক, মালবরাজ দেবগুপ্তের সঙ্গে মিলে কনৌজ রাজ্য আক্রমণ করেন। শশাঙ্ক কনৌজ রাজ গ্রহবর্মাকে হত্যা করে তাঁর স্ত্রী রানী রাজ্যশ্রীকে বন্দিনী করেন। রাজশ্রীর দাদা থানেশ্বরের রাজা রাজ্যবর্ধন খবর পেয়ে কনৌজের পথে অগ্রসর হলে শশাঙ্কের হাতে নিহত হন। তখন রাজ্যবর্ধনের ভাই হর্ষবর্ধন ৬০৬ খ্রীষ্টাব্দে থানেশ্বরের সিংহাসনে বসেন। হর্ষবর্ধন কনৌজ অভিযান করে বোন রাজশ্রীকে উদ্ধার করেন। সে অর্থে রাজশ্রী যুদ্ধবন্দি হয়েছিলেন। যুদ্ধ মানেই সম্পদ লুঠ আর নারীহরণ।
অনেকে মজা করে বলেন, ইতিহাস মানে শুধু যুদ্ধের সালতামামি। তাই যদি ইতিহাসের পাতায় লক্ষ্য রাখি নারীহরণ অহরহ হয়েছে। যুদ্ধ মানেই নারীদের সর্বনাশ। নারীরা সরাসরি যুদ্ধ করতেন না বটে, কিন্তু যে পক্ষের পরাজয় ঘটত, সেই দেশের নারীরা সহজেই লুঠ হতো অন্যান্য সম্পদের মতো। যুদ্ধে পাওয়া বন্দিনী নারী বিক্রয়ের জন্য বা সম্ভোগের জন্য ব্যবহৃত হতো। ভারতবর্ষে অনেক বাজারে এইসব নারী সুলভে বিক্রি হতো। আফ্রিকার পর্যটক ইবন বতুতা চতুর্দশ শতকের শেষ ভাগে ভারতে এসেছিলেন, তিনি তখন বাংলায় এক ‘দিনার’-এ মেয়ে বিক্রি হতে দেখেছিলেন এবং তিনি কিনেও ছিলেন একটি দাসী। ‘রাজতরঙ্গিনী’তে উল্লেখ আছে, তুরস্কের বণিকেরা বহুদেশ থেকে নারী সংগ্রহ করে বিক্রি করত।
বাংলায় সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা হয়েছিল মগদের সময়ে; পর্তুগীজ, আরাকান জলদস্যুরা বাংলার নদী তীরবর্তী অঞ্চলে হানা দিয়ে লুটপাটের সঙ্গে সঙ্গে বহু পুরুষ নারী ধরে নিয়ে যেত ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করার জন্য। যার ফলে সুন্দরবনের বিস্তৃত অঞ্চল জনশূন্য হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় অস্থিরতা যুগে যুগে নারী পণ্যের বাজারকে সমৃদ্ধ করেছে।
(ক্রমশ)
তথ্য ঋণ:
১) পৌরাণিক অভিধান – সুধীরচন্দ্র সরকার
২) ভারতের ইতিহাস – প্রভাতাংশু মাইতি
৩) বাঙালি নারী, হাজার বছরের ইতিহাস – মাহমুদ শামসুল হক, হাতেখড়ি (বাংলাদেশ)