পর্ব ২০

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

জীবনে আমরা অনেক কাহিনী শুনে থাকি। সত্য , অসত্য ,গল্পকথা। কিন্তু মোস্তফা শেখের কাহিনী একদম অন্যরকম। একজন সাধারণ লাঠিয়াল, তারপর জলদস্যু। এবং দস্যুনেতা।  এই পর্যন্ত সমস্তটাই ঠিকঠাক। কিন্তু একবার যদি গল্পের ভিতরের গল্পটাকে বার করে আনা যায়, দেখা যাবে লোকটি বারবার চেয়েছে এই দস্যুবৃত্তি, অপরাধমূলক কাজ ছেড়ে একটু শান্তিতে থাকতে। আর সে যতবার চেষ্টা করেছে ,ততবার তাকে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে দস্যুতার জীবনে। অথবা কপাল তাকে টেনে নিয়ে গেছে দস্যুতায়।

অন্য সব ঘটনার সাথে মাস্টারের মানে মোস্তফার কাহিনীর অমিল হল, সে জলদস্যু থেকে দস্যুনেতা হয়েছিল সাধারণ মানুষের জীবনে ফিরে আসার জন্য।  কেমন ছিল দুর্ধর্ষ দস্যুনেতা মাস্টার ওরফে মোস্তফার জীবনকাল? শোনাবো সে কথা পরের কোনও পর্বে। তবে মাস্টার যে তার বাহিনীকে একটা অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছিল সেটা অনস্বীকার্য।

এদিকে আমার কাজ বেড়ে গেল।  লক্ষ্যে পৌঁছতে এখন থেকে আমাকেও পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। এর আগেও আমি চেষ্টা করেছি। তেমন ভাবে পাত্তা পাইনি প্রশাসনের কাছ থেকে। একদিকে যেমন আমাকে সমস্ত খবর রাখতে হবে মোস্তফা বাহিনীর তেমনি একটা ক্ষেত্রও প্রস্তুত করতে হবে। 

লোকে বলে রাজা কান দিয়ে দেখে। প্রথম দিকে এর মানে আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু নানা সময় নানা জায়গায় দরবার করার পরে আমি ধীরে ধীরে বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলাম। প্রথমবার রাজুবাহিনীর সাক্ষৎকার টিভিতে প্রচারের পরে আমি খুব উৎসাহ নিয়ে গিয়েছিলাম প্রশাসনিক উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের কাছে। সেটা ছিল ২০১১ সাল। আমার রাজু বাহিনীর কাছে যাওয়া, সেখান থেকে খবর সংগ্রহ করে আনা— সবটাই বিস্তারিত জানিয়েছিলাম। বলেছিলাম, রাজু বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে চায়। ঘুরে বেড়িয়েছি এক দরজা থেকে অন্য দরজায়। কিন্তু আফশোস সেই সময় কেউ বিষয়টি নিয়ে কোনও উদ্যোগ নেননি। বলা যায়, আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। উল্টে আমার আত্মসমর্পণের তত্ত্বকে উড়িয়ে দেয়া হলো। তার আগেই গঠন করা হয়েছিল একটা টাস্কফোর্স।  যাদের একটাই লক্ষ্য ছিলো, সুন্দরবনের দস্যুদের দমন করা। অভিযান হল রাজুবাহিনীর উপর।  রাজু পালিয়ে গেল। দস্যুসর্দার গেল বদলে।  কিন্তু এত অভিযানের পরেও সুন্দরবনে জলদস্যুতা কমলো না।

এরপর ২০১৩-১৪ সালে আবার আমি চেষ্টা চালালাম। সেই সময় সুন্দরবনে রাজত্ব করছে ইলিয়াস। আমি শুধু ইলিয়াস নয়, এছাড়াও অনেকগুলি বাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত কথা চালাচ্ছিলাম। আমি আর এক দফা প্রস্তাব নিয়ে গেলাম সরকারি উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের কাছে। দস্যুরা আত্মসমর্পণ করতে চায়। না, সেই সময়েও আমাকে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছিল। তবে একটু অনুযোগের সুরে বলতে চাই, আমি শুধু প্রত্যাখ্যাত হইনি, অপমানিতও  হয়েছিলাম।

আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ৱ্যাবের কর্তা ব্যক্তিরা। তাঁদের কথাবার্তায় এমন একটা ভাব ছিল, যেন আমি হলাম সুন্দরবনের সমস্ত দস্যুদের গডফাদার। ইশারায়-ইঙ্গিতে এমনটিও তাঁরা বোঝাতে চাইছিলেন যেন আমার বিরাট স্বার্থ লুকিয়ে আছে দস্যুদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাবে। কেউ কেউ জানতে চাইলেন, ঠিক কত টাকার বিনিময়ে দস্যুদের উমেদারি করতে এসেছি আমি। কত টাকায় বিক্রি হয়েছে আমার সাংবাদিকতা। এই কথাগুলি বারবার বলেছিলেন ৱ্যাবের কর্মকর্তারা।

জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ করাতে আমার মরিয়া চেষ্টা সংবাদ মাধ্যমের একাংশেরও খোরাক ছিল। প্রচার করা হল, ঢাকায় আমার বাড়ি আছে, গাড়ি আছে ,উত্তরায় অ্যাপার্টমেন্ট আছে।

২০১৩-২০১৪ সালের এই ঘটনার পরে আমি আমার কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছিলাম। আসলে ভিতরের তাগিদে একটু ভাটা পড়েছিল। তার অন্য একটা কারণ হল যে জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের জন্য আমি চেষ্টা চালাচ্ছিলাম, তাদের মধ্যে তেমন উদ্যোগ আমার চোখে পড়েনি। এরা মুখে আত্মসমর্পণের কথা বললেও, জীবনে ফেরার মরিয়া চেষ্টা তাদের মধ্যে ছিল না।

জলদস্যুদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেকেই ভাল চোখে দেখেননি। ২৪ ঘণ্টা নজর ছিল আমার উপর। সেটা প্রশাসনের দিক থেকেও আবার সংবাদমাধ্যমের দিক থেকেও। আমি কোথায় যাই, কী করি সবটাই তখন মনিটর করা হতো।

এই সময় আমি আমার পদ্ধতিতে একটু অদলবদল করি। ঠিক করেছিলাম, ৱ্যাবের সঙ্গে কথা বলবো না। কথা বলবো কোস্টগার্ড বাহিনীর সাথে। কারণ, আমার মনে হয়েছিল ৱ্যাব আমার কথা শুনবে না। একটু একটু করে কথাবার্তা চালানো শুরু করলাম।

কিন্তু সবার আগে দরকার যাদের আত্মসমর্পণের জন্য আমি কথা বলবো, সেই মাস্টারবাহিনীর সঙ্গে একবার দেখা করা।

কথাবার্তা চূড়ান্ত হল তাদের সঙ্গে। তাদের বলতে মোস্তফা ও তার ছয় সাথীর সঙ্গে। সময়টা ২০১৫-র ডিসেম্বর মাস। মাস্টারের সঙ্গে ছিল সোহাগ আকন, সুলতান কাকা, ফজলু। আর একজন ছিল সোলাইমান, আমরা তাকে কাকু বলে ডাকতাম। এদের সঙ্গেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যোগাযোগ ছিল আমার। কিন্তু যাবো কি করে? পুলিশ, RAB, কোস্টগার্ড আর বনরক্ষী বাহিনীর নজর রয়েছে আমার উপর। সত্যি বলতে কী, আমি তখন প্রশাসনের কাছে একজন অবিশ্বস্ত ব্যক্তি। আমার মনের মধ্যে ভীষণ দোলাচল।  কী করে যাবো মাস্টার বাহিনীর সঙ্গে দেখা করতে। বার্তা পাঠালাম। ঠিক সময়ে আমি যাবো তাদের কাছে।

দুবলা চরে রাসমেলা। ওই একটা সময় প্রশাসনের দৃষ্টি সম্পূর্ণটাই থাকে মেলার দিকে। প্রায় দেড়-দুই লক্ষ লোকের সমাগম হয় মেলায়। জেলেরা আসে। ট্রলারের সারি পড়ে যায়। আমিও প্রতিবার রাসমেলায় যাই। আমার যাবার পথটা মংলা দিয়ে পশুর নদী পেরিয়ে। এটাই সোজা রাস্তা। সেবার আমি রাসমেলার দিকে রওনা দিলাম সাতক্ষীরা দিয়ে। ওই পথ দিয়ে দুবলার চরে যেতে অনেকটাই ঘুরে যেতে হয়। আমার সঙ্গে ছিল ক্যামেরাম্যান বায়েজিদ ইসলাম পলিন। আমার অফিসের গাড়িটা সাতক্ষীরা থেকে কিছু দূর যাবার পরে এক জায়গায় রেখে দিলাম।  তারপর মিশে গেলাম তীর্থযাত্রীদের মধ্যে। তখন আমরা তীর্থযাত্রী। সাতক্ষীরা থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন সেখানকার সহকর্মী আহসান রাজীব। এই তিনজন। গাড়ি সরিয়ে রেখে ব্যবহার করলাম স্থানীয় স্ট্রান্সপোর্ট। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থল নীলডুমুর ঘাট। সেখানে থেকে খেয়া পার করলাম। তারপর মোটরসাইকেলে গাবুরা। গাবুরার অন্যপ্রান্তে কপোতাক্ষ নদ। সেখানে পৌছলাম  আমরা। কপোতাক্ষ নদের মোহনা থেকে উঠেছিলাম ট্রলারে। প্রায় ৭০-৮০ জন লোক। পুরো সফরটি ছিল আট দশ ঘণ্টার। পথে কোথাও খাওয়ার উপায় নেই। ট্রলারে উঠেও পুরো নিশ্চিন্ত ছিলাম না। মাঝে মধ্যে বনরক্ষী বাহিনী ট্রলারটিকে থামাচ্ছিল। ট্রলারে উঠে সার্চ করছিল। একসময় আমি পোঁছে গেলাম দুবলার চরে।  মিশে গেলাম অগণিত মানুষের মধ্যে।

কপোতাক্ষ নদ

শেষ হলো রাসমেলা। একে একে বাড়ি ফিরছে পূণ্যার্থীর দল।  তিনদিন কেটে গেল। রয়ে গেলাম আমরা কয়েকজন। অপেক্ষা আর একজনের জন্য, যে নিয়ে যাবে আমাদের মাস্টার বাহিনীর কাছে। তার ট্রলারে করে যাবো। সে আর কেউ নয়, আমার সব সময়ের সঙ্গী বেলায়েত সাহেব।

এরপর আমরা যাবো মাস্টার বাহিনীর মাস্টার ওরফে মোস্তফা শেখের কাছে। সে যাত্রাও ছিল  ভীষণ কঠিন ও দুর্গম।

(ক্রমশ)

2 COMMENTS

Comments are closed.