পর্ব ২১
মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।
২০১৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর। দিনভর রাসমেলার পুণ্যার্থীদের সঙ্গে ট্রলারে করে গিয়েছিলাম দুবলার চরে। সুন্দরবনের এই রাসমেলা বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান। সারা দেশ থেকে বহু লোক আসে এখানে। নানা বর্ণের, নানা ধর্মের লোকের সাথে মিশে যেতে ভাল লাগে। তাই প্রতিবার আমি এখানে আসি। বেলায়েত সরদারকে আগেই বলে রেখেছিলাম— আমি আসছি দুবলার চরে। সেই মতো সে তার ট্রলার গুছিয়ে অপেক্ষা করছিল। মিলিত হলাম। আমরা এখন ছয় জন। রাস পূর্ণিমা। আমরা মিশে গেলাম মানুষের মধ্যে। হাজার হাজার মানুষ। সেই রাসমেলায় এসেছিলেন RAB-এর প্রধান বেনজির আহমেদ। তিনি মহাপরিচালক হিসেবে নতুন যোগ দিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি এখন বাংলাদেশের IGP (ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ)। বেনজির আহমেদ ছিলেন সেবারের রাসমেলার প্রধান অতিথি। অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন সুন্দরবন থেকে জলদস্যু নির্মূল করবেন যেকোনো মুল্যে। যাই হোক, একসময় শেষ হল রাসমেলা। পুণ্যার্থীদের এবার ফিরে যাবার পালা। তিনদিন সময় থাকে ফিরে যাবার জন্য। পরিচিত কিছু লোককে বিদায় জানিয়ে আমিও ফেরার পথ ধরলাম।
বেলায়েত সরদারের ট্রলারে চেপে আমরা কিছুদূর গিয়ে একটা খালের ভিতরে ঢুকে গেলাম। কিছুক্ষণ এগিয়ে পৌঁছলাম খালের শেষ প্রান্তে। এখানে অপেক্ষা করতে হবে। আত্মগোপন বলতে পারেন। প্রতিদিন জায়গা পাল্টাতাম আমরা। ডিসেম্বরের শীত। রাতের বেলায় ঠান্ডা লাগতো ভালই। বেলায়তের ছোট ট্রলারে কোনওমতে ছয় জন। আমি, পলিন, রাজীব আর বেলায়েত ভাইয়ের ট্রলারের দুই সহকারি ফারুক ভাই ও সুজন। ওখানেই থাকা ওখানেই খাওয়া। কিন্তু সমস্যা হল, ওই জায়গায় কোনও নেটওয়ার্ক নেই। কি করে যোগাযোগ করবো মাস্টারমবাহিনীর সঙ্গে? ট্রলার থেকে ডাঙায় নেমে ঘুরতে লাগলাম এদিক ওদিক। খুঁজতে লাগলাম কোথায় পাওয়া যায় নেটওয়ার্ক। পেলাম ডাঙা থেকে একটু দূরে এক জায়গায়। তিনদিন পরে এক দুপুরে। খবর পাঠালাম তাদের। আসছি আমরা। তবে দেরি হবে। কখন, কবে এবং কোথায়— সেই সব দিনক্ষণ ঠিক হবে যেদিন রওনা দেবো সেই দিন। চারদিন থাকলাম দুবলার চরের আশপাশে। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট জায়গায়, নির্দিষ্ট সময়ে যোগাযোগ করতাম মাস্টার বাহিনীর সঙ্গে।
দুবলার চর হল জেলেদের একটি সাময়িক বসতি। সুন্দরবনের দক্ষিণে পশুর নদীর মোহনায় একটি বদ্বীপ। শীতকালে বনবিভাগের অনুমতি নিয়ে জেলেরা সেখানে সাময়িক বসতি গড়ে তোলে। পাঁচ মাস সাগরে মাছ ধরা, সেই মাছ শুকিয়ে শুটকি তৈরি করা হয় এখানে। দুবলার চরের শুটকি ভীষণ ভাল শুটকি। প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষের জীবিকা এই চরকে ঘিরে।
দীর্ঘ কয়েক বছরের সম্পর্ক আমার এই জেলেদের সঙ্গে। কাজেই আমার থেকে যাওয়া নিয়ে কারও সেই রকম সন্দেহ হল না। দুবলার চরে ফিরে এসে যোগাযোগ করলাম মাস্টার বাহিনীর সাথে। তারাও সংকেত দিলো। কি ভাবে যাবো, কখন রওনা দেব, কখন গিয়ে ওখানে পৌছবো— সবটাই ঠিক হলো। সব প্রস্তুতি শেষ এবার রওনা দিতে হবে।
সন্ধে নেমেছে। জোয়ার শুরু হল। পশুর নদীর পূর্বপাশ থেকে আমার রওনা দিলাম। পরিচিতদের বললাম, মংলায় ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য, পশুর নদী পুরোটা পাড়ি দিয়ে পশ্চিম পাশ। যাবো হংসরাজ নদী। হংসরাজ নদীর একটি খাল হল মাইটে। আমাদের যেতে হবে ওই মাইটে খালে। ওখান থেকেই দস্যুরা আমাদের নিয়ে যাবে তাদের ডেরায়। বেলায়েত সরদারের ট্রলারে বিবরণ আমি আগেই দিয়েছিলাম ওদের। সংকেত কি হবে সেটাও বলে দিয়েছিলাম। সমুদ্রে রাতে দুই ধরনের আলোর সংকেত ব্যবহার হয়। একটা লাল আর একটা সবুজ। সমস্ত ট্রলারে এই দুই ধরনের আলো থাকতো। আমাদের সংকেত ছিল সবুজ আলো।
যাত্রা শুরু হলো আমাদের। দুবলার মরণ চর থেকে রওনা দিলাম আমরা। পশুর নদী পাড়ি দিয়ে পশ্চিম দিকে নীলকমল পার হয়ে উত্তরে এগিয়ে চলেছি আমরা। ধীরে ধীরে জোয়ার বাড়ছে ,সেই সঙ্গে পানিও বাড়ছে। চারিদিকে কোনও ট্রলার বা নৌকা দেখতে পেলাম না আমরা। সুবিধাই হলো আমাদের। কেউ খেয়াল করছে না। আরও কিছুটা উত্তরে যেতে হবে। তারপর আমার পৌছবো হংসরাজ নদীতে। রাসপূর্ণিমার জোয়ার বলে নদীতে স্রোতের তোড় বেশ ছিল। ট্রলার চলছে তরতর করে। রাতের অন্ধকারে চারপাশের পরিবেশ ভালই লাগছে।
রাত প্রায় আটটা পেরিয়েছে। ডিসেম্বর মাস। রাতে কুয়াশা পড়েছে ভালই। একটু সামনের পথও ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। যেখানে দিয়ে পশুর নদী থেকে হংসরাজ নদীতে ঢোকা যায় সেখানে আবার একটি চর জেগে আছে। ঠিকঠাক পথে এগোতে হবে। নির্দিষ্ট পথে না গেলে ট্রলার আটকে যেতে পারে। তেমন হলে পুরো যাত্রা পন্ড হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের সারেঙ হলেন বেলায়েত সরদার। জাত সারেঙ বলতে পারেন। দক্ষ হাতে একদম সঠিক পথ দিয়ে তিনি ট্রলার নিয়ে ঢুকলেন হংসরাজ নদীতে।
হংসরাজ বেশ বড় নদী। এর পূর্ব প্রান্তে পশুর নদী আর পশ্চিমের নদীটি মিশেছে আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর সাথে। সেখানে কাগা খালের মুখে আছে বনবিভাগ ও কোস্ট গার্ডের টহল ফাঁড়ি। মাস্টার বাহিনীর সঙ্গে আমার যা কথা হয়েছে, তাতে আমাদের দেখা হবে হংসরাজ নদীর ঠিক মাঝখানে মাইটে খালের মুখে। বলা ছিল, আমাদের ট্রলারে সবুজ আলো জ্বালানো থাকবে। যদিও সেই সময় ওইখানে কোনও ট্রলার থাকার কথা নয়। ওই অঞ্চলটিতে সাধারণ জেলেদের চলাচল খুব সীমিত। তারপরে আবার এই নদীটি ডাকাতদের চলাফেরার পথ। তাই রাতের বেলায় কেউ ভুলেও ট্রলার নিয়ে হংসরাজ নদীতে আসেন না। তবুও সাবধানের মার নেই। তাই সমস্ত দিক দেখেশুনে আমাদের পরিকল্পনা করে এগোতে হয়েছিল।
হংসরাজ নদীতে ঢোকার প্রায় চল্লিশ মিনিট পর আমরা পৌঁছলাম মাইটে খালে। এখানে আগে বন বিভাগের একটা টহল ফাঁড়ি ছিল। ফাঁড়ির সেই ভেঙে যাওয়া ঘরগুলি না থাকলেও সেগুলিকে ঘিরে ঝোপঝাড় দেখে চিনলাম খালটিকে। খালের মুখে থামলো আমাদের ট্রলার। পানিতে তখন তীব্র স্রোত। দ্রুত নোঙর করে চুপচাপ ট্রলারে বসে রইলাম আমরা চারজন।
রাত বাড়ছে। ক্ষুধা লাগা শুরু হয়েছে। চুলা জ্বালালাম আমরা। বেলায়েত সরদার কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি রান্না করতে পারে। এদিকে মাস্টার বাহিনী কখন আসবে ঠিক নাই। বেলায়েত রান্না শুরু করে দিলো। আমরা বাকি তিনজন সময় কাটাতে খালে বড়শি ফেললাম। সুন্দরবনের এই জায়গায় মাছ একেবারে ভরপুর। বড়শি ফেলতেই একের পর এক মাছ উঠতে শুরু করলো। যদিও মাছ ধরায় আমাদের কারও মন নেই। বড়শি ফেলাটা নিছক অছিলা। বড়শি ফেলে কান পেতে অপেক্ষা করছি ট্রলারের শব্দ শুনতে পাই কিনা। সবাইকে জোরে কথা বলতে বারণ করে দিলাম। মনযোগ দিয়ে শুধু শোনার চেষ্টা করছি অন্ধকার থেকে কোনও শব্দ এগিয়ে আসছে কিনা। সবাই আমরা ভীষণ টেনশনে। কখন আসবে ট্রলার। কিন্তু যদি মাস্টার বাহিনীর ট্রলার না আসে। কিংবা অন্য কোনও ডাকাত দলের ট্রলার চলে আসে! আসতে পারে কোনো আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নৌযান! একটা শিরশিরানি অনুভব করলাম ভিতরে ভিতরে।
(ক্রমশ )