পর্ব ২২

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

নিশুতি রাত। আকাশে চাঁদ ছিল না। চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। একটা ট্রলারে বসে আছি আমরা। ওদিকে বেলায়েত সরদার রান্নার কাজে ব্যস্ত। আমরা ছিপ হাতে নিয়ে বসে আছি। মাছ উঠছে। খেয়াল নেই আমাদের। একটা চাপা টেনশন। ভেতরটা যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে। ফিসফিস করে গল্প করছিলাম সহকর্মী বায়েজিদ ইসলাম পলিন, আহসান রাজীবের সঙ্গে। বেশি জোরে কথা বলতে পারছি না। পারছি না বলা ভুল, পরিস্থিতি এমন যে জোরে কথা বলা যায় না। বিশাল হংসরাজ, জোয়ারের স্রোত এতটাই তীব্র যে ট্রলারটাকে দুলিয়ে দিচ্ছে বার বার। মনে হচ্ছে, নদীর নিজের যেন একটা জীবন আছে। সমুদ্র একদম কাছে। নদীর পানি লবণাক্ত। শিবসার দক্ষিণে নীলকমলের আগেই এ নদী। পিছনে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ অরণ্য। শিকার খুঁজতে রাতে বেরিয়ে পড়ে প্রাণিকূল। এই অঞ্চলে এমনিতেই বেঙ্গল টাইগারের আনাগোনা বেশি। হরিণ আর বন্যশুকরের অবাধ চলাফেরা দেখা যায় দিনরাত। পানিতে আছে কামট বা হাঙর। জেলেরা বলে, এদের ভয়ে কুমিরও সহজে খাঁড়িতে আসে না।

সময় যেন আর কাটছে না। বার বার ঘড়ি দেখছি আমরা। একটা ছোট ট্রলারে বসে আছি। রাত বাড়ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে রাতজাগা পাখিদের হরেক রকম ডাক। নিশাচর এক একটা পাখির ডাক যেন তিরের মতো এসে বেঁধে। আর আছে সুন্দরবনের শিকারির দল। পাকা শিকারি। মন চাইলেই তারা চলে আসে জঙ্গলে, এই অঞ্চলে। চোখের পলকে হরিণ শিকার করে। কখনও কখনও কাঁকড়া। এরা ঘুরে বেড়ায় পুরো এলাকা জুড়ে।

সময় বয়ে যাচ্ছে। ওই ভয়ঙ্কর বনে গভীর রাতে একদল মানুষের অপেক্ষায় আমরা। দুশ্চিন্তা বাড়ছে। যদি মাস্টার বাহিনী না আসে? যদি অন্য কোনও দস্যুদলের মুখোমুখি হয়ে পড়ি? সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হল, কোস্টগার্ড বা বন বিভাগের নৌযানের সামনে পড়লে পুরো অভিযানটাই ভেস্তে যাবে। এই ভাবতে ভাবতে পেরিয়ে গেল আরও দুই ঘণ্টা। বেলায়েত সর্দার রাতের খাবার রেডি করে ফেলেছে। সবার খাওয়া হল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে সব আলো বন্ধ করে দিলাম।  প্রতীক্ষা আর প্রতীক্ষা। কেটে গেল আরও কিছুক্ষণ। ট্রলারের ডেকে বসে আছি আমি আর বেলায়েত সরদার।

কোনও কিছুর শব্দ! যেন মৌমাছি ঝাঁক পার হচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। পশ্চিম দিক থেকে আসছে সেই শব্দটা।  ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে আবার সঙ্গে যোগ হয়েছে পানির সরসর শব্দ। ঘড়িতে দেখলাম রাত ১২টা। ট্রলারে জড়োসড়ো সবাই। শব্দটা এবার স্পষ্ট। হ্যাঁ, এটা সেই ট্রলারে শব্দ। সুন্দরবনের জলদস্যুদের ট্রলারগুলিতে বিশেষায়িত সাইলেন্সার লাগানো থাকে। তাই তার আওয়াজ মৌমাছির গুনগুন শব্দের মতো শোনায়। শব্দটা আমার পরিচিত। গলার ভিতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। আচমকাই সমস্ত নীরবতা ভেঙে মুহূর্তের মধ্যে আমাদের কাছে চলে এল একটি ট্রলার। আবছা আলোয় বুঝলাম ট্রলারটি বেশ বড়। চারপাশে জনা তিরিশেক সশস্ত্র জলদস্যু বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুকানি (হাল ধরা ) ব্যক্তির মাথায় হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট। কারা এরা ?

একটু পরে মৌমাছির গুঞ্জন থেমে গেল। আমাদের ট্রলারের গা ঘেঁষে দাঁড়াল অপরিচিত সেই বিরাট ট্রলারটি। আমি বেরিয়ে ট্রলারের গলুইয়ের গিয়ে দাঁড়ালাম।  উল্টোদিকের ট্রলার থেকে একটি টর্চের আলো জ্বাললো কেউ।  প্রথমে আমার উপরে, তারপর আলোটা ঘুরিয়ে আমাদের পুরো ট্রলারটাকে দেখলো। আমি আর একটু এগিয়ে গেলাম। উল্টোদিকের ট্রলারটি এবার একেবারে আমাদের ট্রলারটির পাশে। আমি শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম। এটা মাস্টার বাহিনীর ট্রলার , যার প্রতীক্ষায় আমরা বসে আছি এতক্ষণ। তবুও ভয় যেন কাটছে না। টেনশন কমিয়ে নার্ভগুলির স্থিতাবস্থায় আসতে সময় লাগছে। তখন আমার চোখদুটো খুঁজছে সেই মানুষটাকে।  কোথায় মাস্টার ? একটু পরে পুরো শঙ্কা কেটে গেল। বেরিয়ে এল ছোটখাটো চেহারার একজন মানুষ। মোস্তফা শেখ! মানে মাস্টার। একটি এইট শ্যুটার অটোমেটিক বন্দুক তার হাতে। অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। ধরলাম সেই হাত। তারপর এক লাফে চড়ে বসলাম সমরসজ্জায় সজ্জিত অতিকায় সেই ট্রলারটির ভিতরে।

কেটে গেল আমাদের সমস্ত ক্লান্তি ও শঙ্কা। সবার মুখে ফুটে উঠলো হাসির রেখা। ট্রলারে সমস্ত দস্যুরা এগিয়ে এল আমাদের দিকে। সকলের হাতে বন্দুক আর কোমরে গুলি ভর্তি পোসেস।

আমাকে জড়িয়ে ধরলো মাস্টার। তারপর! এক দস্যুসর্দারকে দেখলাম হাউহাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়তে। সুন্দরবনের দোর্দন্ডপ্রতাপশালী দস্যু মোস্তফা শেখ ওরফে মাস্টার বাহিনীর মাস্টার কাঁদছে। আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আমার সহকর্মী আর দস্যুদলের সমস্ত দস্যুরা। তাদের কেউ আমার চেনা কেউ অচেনা।

মাস্টারকে ওই ভাবে কাঁদতে দেখে আমার মনে হল, কী পাপ করলে একজনকে গরিব হয়ে জন্ম নিতে হয়। আমি সঙ্কল্প করেছিলাম, সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করার চেষ্টা আমি শেষ পর্যন্ত করে যাবো। আমি চেষ্টা করবো। কারণ, আমি জলদস্যুতাকে ঘৃণা করি কিন্তু জলদস্যুদের নয়। আমি জানি, এদের মধ্যে ৯০ শতাংশ মানুষ পরিস্থিতির শিকার। অবর্ণনীয় অভাব ,অসহ্য পরিস্থিতি এদের বাধ্য করে এই পেশায় আসতে।  মাস্টার কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ভাই এটাই আমার শেষ সুযোগ।”

আর যেটা বললেন না, আমি বাঁচতে চাই ভাই। একটু সুযোগ করে দাও আমরা যাতে একটু শান্তিতে বাঁচতে পারি।

কিছু পরে ট্রলার রওনা দিলো। যাবো ঝাইলোর খালে।

(ক্রমশ)

3 COMMENTS

Comments are closed.