পর্ব ২৩

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

সাক্ষাৎ হল মাস্টার বাহিনীর নেতা সেই মাস্টারের সঙ্গে। কুশল বিনিময় হল সবার সাথে। পরিচিতদের আলিঙ্গন আর অপরিচিতদের সঙ্গে পরিচয়। আবার যাত্রা শুরু। গন্তব্য, মাস্টারের ডেরা। রওনা দিলাম আমরা। যাবো ঝাইলোর খালে। বেশ কিছুটা পথ আরও যেতে হবে। ছোট ছোট খাল দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। সামনে মাস্টারবাহিনীর ট্রলার, আর পিছনে বেলায়েত সর্দারের। আমি আর পলিন বসে আছি মাস্টারের ট্রলারে। ট্রলার এগিয়ে চলেছে গোপন আস্তানার দিকে। আমরা  যাচ্ছি পশ্চিমদিকে হংসরাজ নদী ধরে। এবার গহীনে যাবার পালা। সেখানে রয়েছে মাস্টার বাহিনীর আস্তানা। সুন্দরবনের দস্যুদের স্থায়ী আস্তানা ছিলো না। প্রায় প্রতি রাতেই তারা জায়গা বদল করতো। নিরাপদ বুঝলে কোথাও দুই/তিন দিন অবস্থান করতো। দস্যু সম্রাট রাজু বাহিনীর ডেরায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পর থেকে বনদস্যুরা স্থায়ী ডেরা করা ছেড়ে দিয়েছিলো।

মাস্টারের সাথে দেখা হল প্রায় দু’বছর পরে। আগে যেবার দেখা হয়েছিল, সেই সময় সে ছিল মোস্তফা শেখ। একজন জলদস্যু যে ফিরে এসেছিল সাধারণ জীবনে, আর আজ সেই মানুষটি একজন দস্যুনেতা, যে লড়াই করছে সাধারণ জীবনে আবার ফিরে যাবার জন্যে।

কিছু সময়ের মধ্যেই জমে উঠল গল্প। দু’বছরের কথা অল্পতে শেষ হবার নয়। গল্প, আড্ডার সঙ্গে মুখটাও চলছিল বেশ। এই ট্রলারগুলিতে সবসময় চায়ের ব্যবস্থা থাকে। লাল চা। তবে আমার জন্য দুধ চায়ের বিশেষ ব্যবস্থা করেছে মাস্টার। রয়েছে হরেক রকমের ফল। যত ইচ্ছে খাও। এদিকে যখন আমার চা খাওয়া চলছে সেই সময় দুম করে কেউ একটা গুলি ছুড়লো। চমকে গেলাম আমি। রীতিমতো বুক কেঁপে উঠেছিল। কি ব্যাপার! ঘটনাটা কি? বেরিয়ে এসে দেখি খালের ধারে কেওড়া গাছে বসে থাকা বকের ঝাঁকের উপর গুলি চালিয়ে দিয়েছে এক দস্যু। নিস্তব্ধতার মধ্যে হঠাৎ ওই গুলির শব্দ যেন ধ্বনি প্রতিধ্বনি হচ্ছিল। বারণ করলাম দস্যুটিকে।

-দেখো আমি অনেক ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসেছি। একটা লক্ষ্য আছে আমাদের। কোনও অহেতুক কারণে পুরো অভিযান নষ্ট হয়ে যাক, সেটা আমি চাই না। আর আমার অতীত অভিজ্ঞতাও ভাল নয়। তাই অপ্রয়োজনে গুলি ছুড়তে যেও না। ওরা মেনেও নিল আমার কথা। 

সুন্দরবনের বনদস্যুদের ট্রলারগুলো একদমই ভিন্ন ধরনের। মোটামুটি একটা সংসার বলা যায়।  কি নেই তাতে? বোতলের পানি, চাল-ডাল-লবণ- তেল-মশলা। প্রায় একমাস চলার মতো সবকিছু মজুত থাকে সেই ট্রলারগুলিতে। বেশির ভাগ ট্রলারেই সাইলেন্সার লাগানো। ফলে বিকট শব্দ হয় না। শুধু মৌমাছির গুনগুন  শব্দ ছাড়া। আর ট্রলারগুলির ভয়ঙ্কর গতি। ঘণ্টায় প্রায় ৪০-৫০ কিলোমিটার  চলতে পারে ট্রলারগুলো। কিন্তু সেই গতিতেও পানি কেটে যাবার সরসর শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। বনদস্যুরা তাদের ট্রলারগুলো নিজেদের মতো করে তৈরি করে। সাধারণত দ্রুতগতির ছোট ছোট লঞ্চের শক্তিশালী ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় এই ট্রলারগুলিতে। এক হাতে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ। আছে সেলফ স্টার্ট। সিক্স সিলিন্ডার ইঞ্জিনটি বেশ শক্তিশালী। সামনে পিছনে গিয়ার। দ্রুতগতিতে চলা ট্রলারটিকে সাধারণ স্পিডবোট চালিয়ে ধরা সম্ভব নয়।

যাই হোক, আমাদের ট্রলার তখন গতি বাড়িয়ে ফেলেছে। একসময় আমরা বড় নদী থেকে  ঢুকে পড়লাম ছোট খালে। আগেই বলেছি, আমাদের গন্তব্যস্থল ঝাইলো খাল। ওখানে যাবার আগে পর্যন্ত আমি ঝাইলো খাল চিনতাম না। তখন রাত কেটে ভোরের আভা দেখা দিয়েছে। আমরা গিয়ে পড়লাম ঝাইলো খালে। ওখানে পৌঁছে প্রথম যেটা অবাক লাগলো, তা হল চারদিকে প্রচুর মানুষের গলা শুনতে পেলাম আমি। কি ব্যাপার! এই গহীন জঙ্গলে এ-তো সকালে এতো মানুষের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে, কোনও লোকালয়ে চলে এসেছি। কৌতূহলে মুখ বাড়িয়ে দেখি, ছোট খালটার মধ্যে পরপর কয়েকটি ট্রলার লম্বা করে দাঁড়িয়ে আছে। সবে জোয়ার শেষ হয়েছে।  এখন ভাটার সময়। এবার প্রথম কাজ হল, পানি নামার আগে আমাদের বাইটলো নদী থেকে খালের ভিতরে ঢুকতে হবে। সুকানিতে সোহাগ আকন। দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি। আমাদের ট্রলার খালের ভিতরে ঢুকে গেল। তারপর একজায়গায় দাঁড়িয়ে সবগুলি ট্রলারকে একটা সিরিয়ালে লম্বা করে দাঁড় করানো হল। প্রথমে বেলায়েত সর্দারের ট্রলার। তারপর একটা দস্যু ট্রলার, তারপর  মাস্টার বাহিনীর মূল ট্রলার, দস্যুদের আর একটি ট্রলার। এরপর যে ট্রলারগুলিকে রাখা হল সেগুলি বিভিন্ন জায়গা থেকে অপহরণ করে আনা।

এর মধ্যে খালের পাশে এক জায়গায় দেখলাম বেশ কিছু লোক কাজ করছে। ওখানে পলিথিন, গোলপাতা দিয়ে একটা ছাউনির মতো করা হচ্ছে। জানতে পারলাম, প্রায় ৫৩-৫৪ জন জেলেকে সাগর থেকে ধরে আনা হয়েছে। তাদের রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে ওখানে। শীতের সময় বলে ছাউনির ব্যবস্থা। অপহৃত জেলেদের চোখে মুখে ভয়, আতঙ্কিত চেহারাগুলোর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। মুহুর্তেই মনটাকে শান্ত করলাম। এই অত্যাচার বন্ধ করতেই তো এতো ঝুঁকি আর ঝক্কির মধ্যে দিয়ে কাজ এগুনোর চেষ্টা করছি! এই জেলেদের জীবন নিরাপদ করতেই তো কাজ করছি।

এদিকে আমাদের আড্ডা জমে উঠেছিল। বার বার চা সেই সঙ্গে অল্পবিস্তর নাস্তা। সময় কেটে যাচ্ছিল বেশ তাড়াতাড়ি। গল্পের মধ্যে দিয়ে একটা জিনিস বুঝতে পারলাম, মাস্টারের একার সিদ্ধান্তে আত্মসমর্পণের কথাবার্তা চালানো যাবে না। এর মূল কারণ হল, সুন্দরবনে ইতিমধ্যেই  মাস্টারবাহিনী একটা পরিচিতি লাভ করেছে। তাছাড়া, আত্মসমর্পণের বিষয়ে আমার সঙ্গে কথা হচ্ছিল মাস্টার-সহ বাকি আরও ছয়জনের। যা কিছু করতে হবে এদের মতামত নিয়েই করতে হবে। ওই ছয়জন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আমার সঙ্গে যা কিছু কথা বলার বলবে সোহাগ আকন। সে-ই তাদের মুখপাত্র। 

এর আগে ফোনে কথা হলেও সোহাগের সঙ্গে আমার ওখানেই প্রথম দেখা হয়। এবার আমি ও সোহাগ  ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। তবে আমার প্রাথমিক এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল, একটা ইন্টারভিউ নিতে হবে। মাস্টারবাহিনীর ইচ্ছেটা আগে বহির্বিশ্বের সামনে আসুক।

আমরা তিনদিন ছিলাম সেখানে। এর মধ্যে আমি ইন্টারভিউ নিলাম মাস্টার বাহিনীর কিছু সদস্যের। অপহরণ করা কিছু জেলে ছিল আমার পূর্বপরিচিত, তাদেরও ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। সন্ধের পরে এক জায়গায় মিলিত হয়েছিলাম, সেখানে নামাজ কালাম পড়ার পরে একেবারে খোলামেলা কথা হচ্ছিল দস্যুদের সঙ্গে। অবাক হয়ে দেখলাম, কেমন যেন একটা পাপবোধ কাজ করছে তাদের ভেতরে। সবাই চাইছে দস্যুতার পেশা থেকে মুক্তি পেতে। কিন্তু তাদের বদ্ধ ধারণা, জলদস্যুতা থেকে মুক্তি পাবেনা তারা। 

কেটে গেছে দু’টো দিন। আজ তৃতীয়দিন। আমার ফেরার পালা। সকালের নাস্তা করা হয়ে গেছে। সুবিধা মত সময়ে ফিরতে হবে। তখন ভাটা শেষ, জোয়ার শুরু হয়েছে। সবক’টা ট্রলারের তলা থেকে জল সরে কাদার উপরে দাঁড়িয়ে। এমন অবস্থায় যদি কেউ আক্রমণ করে পালানোর উপায় নেই। ঠিক সেই সময় একটা মেগাফোনের আওয়াজ। কোস্টগার্ড বাহিনী আক্রমণ করেছে। সব মিলিয়ে আমরা প্রায় দেড়শ জন। পালাবো কোথায়? বুঝতে পারলাম এক ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন আমরা। মৃত্যু একেবারে দোরগোড়ায় হাজির।

(ক্রমশ)