পর্ব ২৪

(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)

তৃতীয় দিন সকাল! আমার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মনে রাখার মতো একটি দিন। ওই দিন আমার ঘুম একটু দেরিতে ভাঙলো। কারণ, আগের দু’দিন দুই রাত পুরোটাই না ঘুমিয়ে কাটিয়েছিলাম। যা কিছু ক্লান্তি কাটানোর জন্য ভোরের দিকে শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দিতাম। এইরকম সফরে এলে, সে দু’রাত হোক বা তিন রাত, আমি ঘুমাই না। আমার সঙ্গে যারা থাকতো সবাইকে পালা করে ঘুম পারাতাম কিন্তু আমার ঘুম আসতো না। যাই হোক, তৃতীয়দিনে খুব ভোরের দিকে শরীর বিদ্রোহ করে বসলো। বাধ্য হয়ে শরীরটাকে কিছুক্ষণ এলিয়ে দিয়েছিলাম বিছানায়। আমি ছিলাম মাস্টারের মূল ট্রলারে। কেউ আমাকে ডাকছিল না। কিন্তু তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় কিছু কথাবার্তা শুনতে পারছিলাম। আমাদের শুটিংয়ের কাজ শেষ হয়ে গেছে আগের দিন। মানে, যা সাক্ষাৎকার নেবার সব কাজ আগেরদিন শেষ হয়ে গেছে। কাজেই ভিডিও ক্যামেরা বা আনুসঙ্গিক জিনিসগুলি ট্রলারের ভিতরে রাখা। ট্রলার বলতে বেলায়েত সরদারের ট্রলারে। আগের পর্বে বলেছি, ট্রলারগুলি কিভাবে সাজানো ছিল। প্রথমে বেলায়েত সরদারের ট্রলার। তারপর একটা দস্যু ট্রলার পরে মাস্টারের মূল ট্রলার, আর একটা দস্যু ট্রলার তারপর বাকি ট্রলারগুলো লাইন দিয়ে ভিতরে রাখা। সেই জায়গায় পানি হাঁটু পর্যন্ত, কাদা পানি বলতে পারেন। সেটা জোয়ারের সবে শুরুর সময়। অর্থাৎ চাইলেও ট্রলার বের করা যাবে না। বাকিদের কথাবার্তায় আমার তন্দ্রা ভেঙে গেল। উঠে দেখি, বেলায়েত সরদার একটা গামছা পরে কাদায় মধ্যে নেমে ট্রলারের নীচে ইঞ্জিনে কাজ করছে।  আজ আমাদের ফিরে যাবার দিন। তাই শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে ট্রলারটা ঠিক আছে কিনা। আগেই ওর ট্রলারের ইঞ্জিনে একটু সমস্যা ছিল। সেটাই ঠিক করছিল। অনেকটা পথ যেতে হবে। বেলাও হয়েছে কিছুটা। এর মধ্যে আমি বসলাম সকালের নাস্তা নিয়ে। তখন কত হবে এই সাড়ে এগারোটা বা বারোটা। নাস্তা বলতে একটু ভাত রাখা ছিল আর ইলিশ মাছ ভাজি। ওই দিয়েই নাস্তা করে নিলাম। নাস্তা শেষ হয়েছে বোধ হয় দু- তিন মিনিট হবে। মাস্টারের ট্রলারে আমি একটু আয়েশ করছি। আমার পরনে তখন টিশার্ট আর গ্যাবাডিনের প্যান্ট। সবাই খুব ক্যাজুয়াল অবস্থায়। যেমন বেলায়েত  গামছা পরে , পলিন একটা শর্টস পরে, আমার সঙ্গে যে আর একজন সাংবাদিক ছিলেন সাতক্ষীরার  রাজীব, ওর পরনে শুধু লুঙ্গি। নাস্তা শেষে এক কাপ লাল চা আমার হাতে। ঠিক সেই সময় একজন তরুণ দস্যু , তরুণ বললে ভুল হবে একেবারে বাচ্চা একটা ছেলে  দৌড়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়লো আমাদের ট্রলারের উপর। রীতিমতো হাঁফাচ্ছে।

–প্রশাসনের লোক আসছে।

–কে ? শুনে মুহূর্তের মধ্যে কেমন শক্ত হয়ে গিয়েছিলাম আমি।

ঠিক কতটা সময় আছে আমাদের হাতে ? কোথায় যাবে ? কিভাবে যাবো? জিনিসগুলি গুছিয়ে নিতে পারবো তো? অনেক চিন্তা মুহূর্তের মধ্যে ভিড় করে এলো। প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে আমার যখন হুশ এল, খুঁজতে লাগলাম আমার লোকজনেরা কোথায়। না দস্যুরা নয়। আমার লোকজন। আমরা ছয়জন, সবাই আমার দায়িত্বে। বেলায়েত ,পলিন, রাজীব ,সুজন ,ফারুক ভাই– কোথায় সবাই ? পলিন আর রাজীবকে দেখলাম আমাদের মূল ট্রলারে আছে। সেই মুহূর্তে কী মনে হল, পলিনকে বললাম, “নামেন আর দৌড়ান।”

 চিৎকার করে বললাম, “বেলায়েত ভাই নিরাপদে চলে যান।”

এর মধ্যে মাস্টার বাহিনীর দস্যুরা আমাকে ঘিরে ফেললো। তাদের মধ্যে ছিলেন মাস্টার নিজে আর সোহাগ আকন। আমাকে বললো, চলুন আমরা আপনাকে সেফ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। সোহাগের কথাও বোধ হয় শেষ হয়নি,  দূর থেকে ভেসে আসলো ঠ্যা ঠ্যা করে বন্দুকের গুলির শব্দ। মুহূর্তের মধ্যে চললো কয়েক রাউন্ড গুলি। সেই সময় আমরা ছিলাম বড় নদী থেকে যে ঝাইলো খাল, তার মুখে। পরে বুঝেছিলাম, ওই জায়গাটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, যদি একবার বড় নদী দিয়ে বা অন্য দিকে খাল দিয়ে আক্রমণ করা হয়, পালানোর উপায় থাকে না। কিন্তু আমাদের ভাগ্য ভাল, কোস্টগার্ড একদিক থেকে এসেছিল। কোস্টগার্ডের কাগা অফিস থেকে ওই দলটি এসেছিলো। একটা স্পিডবোট নিয়ে খুব আস্তে আস্তে একেবারে চুপিসারে কোস্টগার্ড ওখানে এসেছিল। একবারে সঠিক লোকেশন জেনেই  এসেছে বোঝা গেল। খুব চুপিসারে ওরা স্পিডবোর্ডটা ভিড়িয়েছিল। সেই সময় ওই দস্যু ছেলেটি দেখে ফেলে। আমরা শুধু ওইটুকু সময় পেয়েছিলাম। ওদিকে কোস্টগার্ডের সদস্যরা গুলি ছুড়তে শুরু করেছে। মাস্টার বলল, কেউ গুলি ছুড়বে না। সবাই পালাও এখান থেকে। ভাই আপনিও যান। চিন্তা নেই, সোহাগ আপনাকে ঠিক নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবে। আমিও দৌড় শুরু করলাম। আমার সঙ্গে পলিন আর রাজীব। কিন্তু বেলায়েতরা কোথায় জানি না। তখন সবার সঙ্গে আমরা পালাচ্ছি। আর চারদিকে শুধু কোস্টগার্ডের গুলির শব্দ। 

মাস্টার এদিকে নির্দেশ দিয়েছে কেউ গুলি ছুড়বে না। সবাই পালাও। কিন্তু পালাবো কোথায়? সামনে তো তেমন বড় গাছ নেই যে আড়ালে থাকা যাবে। আসলে সুন্দরবনের এইদিকে পানি লবণাক্ত হবার কারণে সুন্দরী বা কেওড়া গাছ কম। সামনের পুরোটাই গরানের জঙ্গল। গরান গাছ আসলে ছোট ছোট হয়। ওই গাছের আড়ালে লুকনো যায় না। কি করি? ওখানে গেলে আমি হয়তো চোখের আড়ালে যেতে পারবো। কিন্তু গুলি আটকাতে পারবে না ওই গাছগুলি।  আমরা ছুটছি। একদিকে নদী অন্যদিকে খাল। ভীষণ সরু একটা জায়গা। দৌড়নোর সময় গরানের  ডালগুলি গা হাতপায়ে তীরের মতো লাগছে। কেটে যাচ্ছে নানা জায়গা। কোনও হুশ নেই আমাদের। গরানের শ্বাসমূলগুলোর কথা না-ই বা বললাম। আমরা সোজা যাচ্ছি উত্তরে। ওদিকে গভীর জঙ্গল। ওখানে আমরা প্রায় দেড়শ’ জন।  মানে, আমরা ছয়জন , অপহৃত জেলে ও দস্যুরা -সব মিলিয়ে দেড়শ’ জন। সবাইকে লুকাতে হবে। সবাই দৌড়চ্ছে। ওখানে প্রায় ৫০ জনের মতো ছিল যাদের হাতে অস্ত্র ছিল। তাদের উপর দায়িত্ব ছিল অপহৃত জেলেদের নিয়ে যাবার। এখন সবকটি অপহৃত জেলেকে তো একসাথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই ওরা দলে দলে ভাগ হয়ে জেলেদের নিয়ে গেল ভিতরের দিকে।

আর তাদের সাথে দৌড়চ্ছি আমরাও। এই ভাবে প্রায় চলে এসেছি ২০০- ২৫০ মিটার পথ। বুঝলাম, এই ভাবে আমি দৌড়তে পারবো না। পাশে সরে গেলাম। সেই সাথে টেনে নিলাম পলিন আর রাজীবকে। এভাবে দৌড়নো যাবে না। এমনিতেই হাত-পা ছড়ে গেছে ,জামা কাপড় ছিড়ে গেছে। সারা শরীরে কাদা মেখে একাকার। কি করবো। আর তো পারছি না। ওইখানেই গরানের ঝোপের মধ্যেই বসে পড়লাম আমরা। আমি, পলিন আর রাজীব। চারিদিকে শুধু গুলির শব্দ। পলিনকে দেখলাম, ওর কোনও ভয় নেই। কিন্তু রাজীব একেবারে কাঠ হয়ে আছে। আমার কাছে এসে বললো, চলুন ভাই, আমরা সারেন্ডার করি। নইলে এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবো না।

3 COMMENTS

Comments are closed.