পর্ব -২৬

(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)

কোস্টগার্ড চলে যাবার পরে কেটে গেছে প্রায় চল্লিশ পয়তাল্লিশ মিনিট। আমি, পলিন, রাজীব , মাস্টার, সোহাগ আকন ও আরও চার-পাঁচজন দস্যু মিলে একটা খোলা জায়গায় জড়ো হয়েছি। আলোচনা হচ্ছে— এই পরিস্থিতিতে আমাদের কাজ কী হবে তাই নিয়ে। এদিকে কোস্টগার্ড যখন এসেছিল সেই সময় ট্রলারগুলো কাদায় বসে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর কেটে গেছে প্রায় এক ঘণ্টা। নদীতে রীতিমতো জোয়ার শুরু হয়েছে। ট্রলারগুলি ভেসে উঠেছে পানির উপর। কিন্তু বেলায়েত সরদারের ট্রলার তো নষ্ট। আর সেই ট্রলার একমাত্র স্টার্ট করতে পারে বেলায়েত।

এতক্ষণ হয়ে গেল বেলায়তকে দেখতে পাচ্ছি না। ওকে ছাড়া ফেরা অসম্ভব। তবে এইটুকু জানি, সুন্দরবনকে বেলায়েত হাতের তালুর মতো চেনে। মন বলছে, ওর কিছু হবে না। এই ভরসা আমার তার উপর আছে। এর মধ্যে কথা বলতে বলতে দেখি পলিন আর রাজীব গিয়ে ট্রলার স্টার্ট দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওদের দ্বারা স্টার্ট হল না। কাণ্ড দেখে চিৎকার করে বললাম— আপনারা কি পাগল হয়ে গেছেন! ট্রলারটি তো ঠিক নাই, স্টার্ট হয় কোনওদিন?  পলিন  জবাব দিল, চেষ্টা করছি ভাই যদি স্টার্ট হয়।  বললাম, স্টার্ট হলেই বা কি? আমি বেলায়েত, সুজন আর ফারুক ভাইকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। ওদেরকে আগে খুঁজে বের করা হোক।

সেই সময় মাস্টার বাহিনীর একজন আমাকে খবর দিল, বেলায়েত একেবারে খালের মাথার দিকে আছে। ওখানে সবাই নিরাপদ। কথাটা আমার মনে স্বস্তি এনে দিল। যাক, বেলায়েতরা তাহলে ঠিকই আছে।

এই সময় মাস্টার বলল, চলুন আগে মূল ট্রলারে যাওয়া যাক। ওখানে গিয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি চেষ্টা করছি, যে কোনও ভাবে হোক মূল ট্রলারটাকে বার করতে। মানে কাদার মধ্যে দিয়ে ঠেলে ট্রলারকে মূল নদীর স্রোতে নিয়ে আসতে চাইছে ওরা। যখন এসব কথা চলছে, সেই সময় আরও কয়েকজন দস্যু চলে এলো। দশ-বারোজন সশস্ত্র দস্যু । সবাই মিলে কাদায় নেমে প্রাণপাত পরিশ্রম করে মূল ট্রলারকে ভাসালো।  এরপর আমাদের তিনজনকে ট্রলারে তোলা হল। পাঠিয়ে দেওয়া হল ট্রলারের একদম নীচে। সেখানে আমাদের শুইয়ে দেওয়া হল। মাস্টার বাহিনীর লোকেরা আমাদের আশ্বাস দিল,  কোস্টগার্ড যদি আবারও আক্রমণ করে আপনাদের কিছু হবে না।

দস্যুদের ট্রলারগুলো কেমন হয়, তার একটা ধারণা দেওয়া যাক। সাধারণত দস্যুরা তাদের ট্রলারগুলো নিজেদের মতো করে তৈরি করায়। দ্রুতগতির ছোট লঞ্চের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় ট্রলারগুলিতে। এছাড়াও থাকে শক্তিশালী সাইলেন্সার। ফলে পাশ দিয়ে গেলেও ট্রলারগুলির আওয়াজ পাওয়া যায় না। মাস্টার বাহিনীর মূল ট্রলারের যেখানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল, সেটা আসলে একটা কেবিন। সাধারণত কেবিনগুলি থাকে ট্রলারের তলার দিকে। ট্রলারের দুইপাশ, আগা-মাথা মোটা স্টেনলেস স্টিলের পাত দিয়ে মোড়া। ভিতরটা মোটা কাঁথা দিয়ে মোড়ানো। গুলি করলেও তা  ট্রলার ভেদ করবে না। এমন  ভাবে বানানো হতো ট্রলারগুলি। মাস্টারের ট্রলারটিও বিশেষ কায়দায় বানিয়ে নেওয়া। খুলনার কোনও এক নদীর পাড়ে নোঙর করে এটি তৈরি করা হয়েছিল। এই ধরনের তিনটি ট্রলার ছিল রাজুর। দু’টি ছিল ইলিয়াসের। মোতালেব বাহিনীর কাছে ছিল একটি। জুলফু বাহিনীর দু’টি। এছাড়া, শীষ্য, আকাশ বাবুসহ আরও অনেকের একটি করে এই ধরনের ট্রলার ছিল। এই ধরনের ট্রলার তৈরি হতো খুলনার নদীর পাড়ে। লোকালয়ের কিছু লোক দস্যুদের ট্রলারগুলো তৈরি করে দিত। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, দস্যুদের সাহায্য করার অপরাধে তারা কিন্তু কোনওদিন ধরা পরেনি।

মাস্টারও আমার মতোই ভয় পাচ্ছিল— হয়তো ফের আক্রমণ হতে পারে। তাই সাত তাড়াতাড়ি ট্রলার এগিয়ে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিল। পুরো এপিসি কায়দায় আমাদের ওখান থেকে বার করা হলো। ট্রলারে যিনি সুকানি মানে ক্যাপ্টেন, তিনি গায়ে পরলেন জ্যাকেট আর মাথায় হেলমেট। সবাই ভীষণ সতর্ক। দস্যুরা যে যার মতো পজিশন নিয়ে নিয়ে নিয়েছে ট্রলারের আশপাশে সামনে উপরে সব জায়গায়। সবার বন্দুক সামনের দিকে তাক করা। ট্রিগারে আঙ্গুল। যেন কোনও সামরিক অভিযান। জীবনে ওই একবার চোখে দেখেছিলাম বনদস্যুদের সামরিক প্রস্তুতি। এদিকে মাস্টার আমাকে বারবার আশ্বস্ত করল— বেলায়েত ও অন্য সঙ্গীদের ঠিক সময়ে আমাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। তারপর মাস্টার উঠল  ট্রলারের ডেকের উপরে। পায়চারি শুরু করল। ট্রলার যখন একটু চলা শুরু করেছে— দেখলাম, মাস্টার চিৎকার করে বলছে—যারা লুকিয়ে আছেন বেরিয়ে আসুন। এলাকা নিরাপদ। সবাই এসে ট্রলারে উঠুন।

একটু পরে ট্রলারটি বাটলো নদীতে পড়ল। ট্রলার চলেছে সর্বোচ্চ গতিতে। বাটলোর মোহনায় পুরো একটা চক্কর দিল।  তারপর একটি মাঝারি খাল ধরে চললো পনের মিনিটের মত। সেখান থেকে আরেকটা ছোট খালের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলো। কিন্তু ঢোকাতে গিয়ে বিপত্তি। খালটির মুখেই একটি কেওড়া গাছ। ট্রলার ঢোকাতে গিয়ে কেওড়া গাছের একটি ডাল গেলো ভেঙে।

সিদ্ধান্ত হল, ওই খালে আর ট্রলার ঢোকানো হবে না। পিছিয়ে আনা হল ট্রলারকে। এই সিদ্ধান্তের কারণ, কোস্টগার্ড যদি আবার আসে, তবে ভাঙা ডাল দেখে বুঝতে পারবে আমাদের গতিপথ। ট্রলার ঘুরিয়ে আর একটু এগিয়ে গেলাম আমরা। একটু দূরে পাওয়া গেল সুবিধাজনক আরেকটি সরু খাল। বামদিকে। ট্রলার ওই খালে ঢোকানো হল।  কাজটা করা হল খুব সতর্কতার সঙ্গে। যাতে আমরা যে ওই খালে ঢুকেছি তার কোনও চিহ্ন না থাকে। যাই হোক আমরা ঢুকে গেলাম ওই খালের ভিতরে, সোহাগ একটু এগিয়ে গিয়ে ট্রলারটাকে  রাখলো। জায়গায় আগের ঘটনাস্থল ১৫-২০ মিনিট দূরের। ট্রলার থামতে আমি চলে গেলাম মাস্টারের কাছে। আমার কথা একটাই— বেলায়েতদের সঙ্গে নিয়ে ফিরব। যে করে হোক ওদের আনার ব্যবস্থা করা হোক। বেলায়েতের ট্রলার ছাড়া আমি কোথাও যাবো না। মাস্টার আমাকে আশ্বস্ত করে বলল, চিন্তা করবেন না ভাই। সব ঠিক হবে। আমি দেখছি।

এই বলে মাস্টার তার ব্যক্তিগত সহকারী বাচ্চুকে সঙ্গে নিল। সেই সঙ্গে তার বন্দুক, কোমরে পোসেস, একটা ছোট পানির বোতল আর এক প্যাকেট সিগারেট। হেঁটে রওনা দিলো ঝাইলো খালের দিকে। তখন শীতকাল। এই যে দৌড় ঝাঁপ করেছি, কাদায় শুয়েছি , তাতে আমাদের জামাকাপড় সব ভিজে গেছে। ভীষণ শীত করছে।  কি করি? শুকনো জামাকাপড় নেই সাথে। সবই তো বেলায়েতের ট্রলারে। এখন ট্রলার এলে তবে পাবো সমস্ত জামাকাপড়। 

সময় কেটে গেলো অনেকক্ষণ। সন্ধে নামছে। কুয়াশা বাড়ছে গভীর জঙ্গলে। আমার শীত করছে।  মাস্টার সেই কখন গেছে, এখনও ফিরলো না! আর বেলায়েত কোথায়! অনেকক্ষণ হয়ে গেল, তার তো কোনও খবরই পাচ্ছি না। দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে যাবার মতো অবস্থা আমার। কিছু হয়নি তো বেলায়েতের! আর ভাবতে পারছি না কিছু।

(ক্রমশ)