পর্ব ২৯

(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)

এসে পড়েছি  দুবলার চরের আলোর কোল-এ।  মেলার অস্থায়ী দোকানপাট বা থাকার জায়গায়গুলি তখনও পুরোপুরি ভাঙা হয়নি। ওই সকালে আমাদের ট্রলারটি দেখে বেরিয়ে এলো সবাই। এদিকে আমাদের  কিম্ভুত চেহারা। উস্কোখুস্কো, জামাকাপড় ছেঁড়া, কাদামাখা।  কোথা থেকে আসছে এরা! সার বেধে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছে আমাদের। এরা প্রায় সবাই আমার পরিচিত। -আপনারা না চলি গেলেন!  কই গেসিলেন? ফিরা আইলেন যে! কি করসেন! এই অবস্থা কেন আপনাদের? নানা প্রশ্ন। কার কার প্রশ্নের উত্তর দেব? আমি বললাম, আমরা যুদ্ধ করে আসছি। যাই হোক।  ক্ষুধা পাইসে। নাস্তা করান। ওখানেই একটা ছোট সাময়িক হোটেলে আমাদের খাবার ব্যবস্থা করা হলো। একটু চা,পানি, নাস্তা করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলাম। অপেক্ষা করছিলাম কখন পরের জোয়ার আসে। এদিকে বনের গোলাগুলির ঘটনাটি চেপে রাখতে হবে। লোকালয়ে যাওয়া পর্যন্ত বিষয়টি জানাজানি করা যাবে না। এর মধ্যে আমরা আমাদের ক্যামেরা, ক্যাসেট সব কিছু পরীক্ষা করলাম। দেখছিলাম সব কিছু ঠিক আছে কিনা। ক্যাসেটগুলি ঠিক থাকলেও একটা ডিভাইস নিখোঁজ। ট্রাইপড খুঁজে পেলাম না। ওটা হারিয়ে গেছে। দৌড়াদৌড়ির মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে! যাই হোক কি করা যাবে? এখন তো আর ওই জায়গায় যেতে পারবো না। জীবনে প্রথম আমার কাছে থেকে ক্যামেরার ডিভাইস হারালো। মনটা একটু খারাপই হলো সেজন্য।

এরপর জোয়ার আসলে চড়ে বসলাম ট্রলারে। ট্রলার ছাড়লো। রওনা দিলাম মংলার দিকে। ওই এক জোয়ারে আমরা পৌঁছে গেছিলাম মংলায়।

সেদিন বিকেল ঢলে সন্ধ্যা নেমে গিয়েছিল মংলা পৌঁছতে। সে রাতে  মাস্টারকে আমাদের পৌঁছে যাওয়ার সংবাদ দেওয়া হয়নি। পরদিন সকালে দেখি মাস্টার ফোন করেছে। -আপনারা ঠিকঠাক পৌঁছেছেন খবর পাইসি। অর্থাৎ তার লোকজন তাকে আমাদের খবর দিয়েছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম -ভাই আপনাদের কি অবস্থা ? সে বললো — আমাদের সব ঠিক আছে।  কিন্তু গালকাটা রবিউল আর আর সাথে জেলেদের কোনও খবর পাইনি। রবিউল হারিয়ে গেল মাস্টারবাহিনী থেকে। তবে আমি পরে খবর পেয়েছিলাম, রবিউল আর একটা পরিকল্পনা করেছিল। ভেবেছিল, সে ওই জেলেদের নিয়ে যাবে আর তাদের মুক্তিপণের টাকা একাই নেবে। তাই সে ওই জেলেদের নিয়ে অন্য দিকে চলে যায়। পরদিনই ওই জেলেরা রবিউলের বন্দুক কেড়ে নিয়ে, সেটাকে ভেঙে পানিতে ফেলে দেয়। আর রবিউলকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এদিকে, ওই দিন কোস্টগার্ডের আক্রমণের পরে মাস্টার বাহিনীর অর্ধেকের বেশি দস্যু দল ছেড়ে দেয়, কেউ কেউ দস্যুবৃত্তি ছেড়ে চলে যায়।

এদিকে আমার মনে একটা দুশ্চিন্তা দেখা দেয়। কোস্টগার্ড বাহিনীর আক্রমণের পরে মাস্টারের লোকেরা আমাকে বা আমাদের সন্দেহ করছে না তো?  ভয়ঙ্কর সেই অভিযানে হয়তো আমারও প্রাণ যেতে পারতো। আমরাও গেলাম আর কোস্টগার্ডও আক্রমণ করলো। ভীষণ ইতস্তত লাগছিল আমার। কেমন একটা অস্বস্তি। তবে মাস্টার আর ওর সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, ওরা আমাকে সন্দেহ করেনি। মাস্টার আমাকে বলেছিল, ও আমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। একটু স্বস্তি! অন্তত দস্যুদের মনে আমাদের সম্পর্কে কোনও বিরূপ ভাব নেই।

দস্যুরা আমাকে বিশ্বাস করে কিন্তু শহরের মানুষ! প্রশাসন, মিডিয়া, এক শ্রেণীর সরকারি কর্মচারী আমাকে সন্দেহ করে। তাদের চোখে আমি দস্যুদের ইনফর্মার। তাদের পৃষ্ঠপোষক। আমি হলাম একজন অবিশ্বস্ত ব্যক্তি।  এখানে আসার আগে থেকেই ব্যাপক নজরদারি ৱ্যাব-কোস্টগার্ডের আমার উপরে।

মংলায় পৌঁছে বুঝতে পারলাম, আজ আর ঢাকায় যাওয়া যাবে না। ওই রাতটা আমাদের মংলায় থেকে যেতে হল। পরদিন সকাল হতেই আমি গেলাম মংলার জোনাল কোস্টগার্ড অফিসে। কোস্টগার্ড অফিসে গেলাম তার একটাই কারণ— এর আগে প্রতিবার সুন্দরবনের দস্যুদের খবর করে আমি ৱ্যাবের কাছে গেছি। তারা আমাকে নিরাশ করেছে, সেই সাথে অপমানিত হয়েছি আমি। তাই আগেই ঠিক করেছিলাম, এবার আর ৱ্যাবের কাছে যাবো না। যা বলার কোস্টগার্ডকেই বলবো। তখন কোস্টগার্ডের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন মেহেদী মাসুদ। সজ্জন ব্যক্তি। আমি তাঁর কাছে গেলাম। পরিচয় ছিল আগে থেকেই। উনি আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। ওই কাদামাখা, একদিক পোড়া  প্যান্ট, ছেঁড়া জামা। যা-তা অবস্থা আমার।  কৌতূহল চেপে রাখতে পারলেন না।

—একি অবস্থা আপনার? কোথা থেকে আসছেন?

— কাল আপনাদের সাথে একটু যুদ্ধ হয়েছিল। ওখানেই ছিলাম আমি।

—মানে, কাল যে কোস্টগার্ডের অপারেশন হলো সেখানে আপনি ছিলেন?

আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম।

—কি বলছেন! ওইখানে আপনি ছিলেন? আপনি আমাদের বলে যাবেন না? 

—আমি হেসে দিলাম – বললাম, আমার কাজটাই তো গোপনীয়।  আপনাদের বলে গেলে চলবে কি করে?

যাই হোক, সবটা খুলে বললাম তাঁকে। বললাম, সুন্দরবনের মাস্টার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে চায়। বোঝানোর চেষ্টা করলাম, এটা  কত বড় সুযোগ আমাদের সামনে। সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দলগুলির একটা যদি আত্মসমর্পণ করে, তবে কি বার্তা যেতে পারে বাকি দলগুলির কাছে।

তিনি আমার কথা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর সৌজন্য প্রকাশ করে আমাকে বললেন— বাহ্! এতো খুব ভাল কথা। 

ক্যাপ্টেন মেহেদী মাসুদের সঙ্গে দেখা করার পরে আমি গেলাম স্থানীয় পুলিশের কাছে। তাদের সঙ্গেও একপ্রস্ত কথা হল আমার। স্থানীয় পুলিশ কর্তা বললেন, হ্যাঁ, আপনি বাহাদুরির কাজ করেছেন। আমাদের এটা করা উচিত। আমি উপরে কথা বলছি।

ব্যাস, ওই পর্যন্ত!

কোনওরকম পজিটিভ উত্তর পেলাম না আমি। অথচ সেই সময় আমি বললেই মাস্টার তার পুরো বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ করতো। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবহেলা আর গা এড়িয়ে চলার চেষ্টা আমাকে অবাক করেছিল। আমি সেই সময় সত্যি সত্যি সবার দরজায় দরজায় ঘুরছিলাম।  কোনও সুরাহা হচ্ছিল না। কারও যেন আগ্রহ নেই সুন্দরবনের ৩০ লক্ষ মানুষ ও জলদস্যুদের ব্যাপারে।

(ক্রমশ)

1 COMMENT

Comments are closed.