পর্ব ৩০
(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)
কোস্টগার্ড, স্থানীয় পুলিশ তারপর ৱ্যাব— এক এক করে দরজা বন্ধ হচ্ছে আমার। কেন এই অনীহা? কেন একবারও কেউ ভেবে দেখছে না জলদস্যুদের নিকেশ করার চেয়ে সুন্দরবনের স্থায়ী সমাধান বেশি জরুরি। সেই ৪০-৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকায় জলদস্যুদের বাড়বাড়ন্ত। জলদস্যুদের এই ব্যবসা কি শুধু শক্তি প্রয়োগ করে বন্ধ করা যাবে? হতে পারে সেটা ? একটা জিনিস আমি বুঝেছি। জলদস্যুরা সাধারণ মানুষের চোখে গণশত্রু। হ্যাঁ ! তাদের কাজ অনেকটাই এর জন্য দায়ী। কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়াতে শুধু তারাই দোষী? না, এমনটা নয়। আর সেটা অনেকটাই দেখানো হয়। এর সঙ্গে যুক্ত ডাঙার কিছু লোক। কোনও জলদস্যুর বা দস্যুনেতার মৃত্যুর খবর জনগণকে উল্লসিত করে। পরে দেখা যায়— হয়তো ওই নেতার বা কোনও জলদস্যুর মৃত্যু হয়েছে, কিন্তু তাদের ব্যবসাটা থেকে গেছে বরং আরও বেড়েছে। এটাই চলছে দিনের পর দিন। সেটা নিয়ে প্রশ্ন করে না কেউ। আমি জাত সাংবাদিক নই— তাই সেই প্রথাগত সংবাদ পরিবেশন আমার আসে না। বাংলাদেশে আমার কাছের বন্ধুরা আমাকে বলেন, আমার কাজে নাকি ওরা চারণ সাংবাদিক প্রয়াত মোনাজাতউদ্দিনের ঝলক দেখতে পায়। মোনাজাতউদ্দিন সারা বাংলাদেশে পায়ে হেঁটে সংবাদ সংগ্রহ করতেন। যেখানে যে সমস্যার খবর পেয়েছেন, সেখানেই গেছেন। তারপর সংবাদের মূল খুঁজে বের করেছেন। আমি যখন থেকে সাংবাদিকতা শুরু করি তখন থেকেই তাঁর নাম অনেক শুনেছি। কিন্তু তাঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি। আমিও বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায়, পাহাড়ে, নদীতে, সাধারণ মানুষের সাথে মিশে কাজ করতে ভালবাসি। শহরের খুঁটিনাটি খবর তো প্রতিদিনই চলছে মিডিয়ায়। কিন্তু ওই সব প্রান্তরের খবর? সাধারণের সঙ্গে মিশে গিয়ে, তাদের কথা মানুষকে জানানোই আমার নেশা বা পেশাও বলতে পারেন। শহরে বসে সাংবাদিকতা না করে, এই যে প্রান্তিক মানুষের সামনে গিয়ে তাদের সমস্যা শোনা, তাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার সাথে একাত্ম হওয়া, এটাই বোধ হয় আমাকে জলদস্যুদের মূল সমস্যা বুঝতে সাহায্য করেছিল। আর আমার মনে হয়, এই জায়গায় ঘাটতি ছিল সিস্টেমের। গোটা বিষয়টাই চলছিল আমলাতান্ত্রিক পথে। টেবিলে বসে সমস্যা সমাধানের দিকে তাদের নজর ছিল বেশি। তাই হয়তো আমার বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলি বুঝতে ওদের সমস্যা হয়েছিল অথবা এমনটা হতে পারে আমি তাদের ঠিক করে বোঝাতে পারছিলাম না। শুধু বন্দুক দিয়ে জলদস্যু খতম হতে পারে। কিন্তু জলদস্যুতা খতম হবে না। এই সামান্য কথাটি তারা বুঝতে পারছিলেন না।
যাই হোক, প্রশাসনের দরজায় ঘুরতে ঘুরতে মাস্টার বাহিনীর যে ভিডিওগুলি করা হয়েছিল সেগুলি সম্প্রচার করা হয়নি। আমি অপেক্ষা করছিলাম। সরকার কোনও সবুজসঙ্কেত দেয় কি না।
যদি কোনও সবুজসঙ্কেত পাই তখন এই সব ভিডিও প্রচার করা হবে।
দিন যায়। সরকারের দিক থেকে কোনও ইতিবাচক সাড়া আসছে না। উল্টো আমার এই প্রচেষ্টার ফলে নানা জায়গায় থেকে শুনছিলাম নেতিবাচক কথাবার্তা। সেই সমালোচনার অনেকগুলি হয়েছিল আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও।
এক শ্রেণির মানুষের চর্চার বিষয় হয়ে উঠছিলাম আমি। ধীরে ধীরে হতাশা গ্রাস করছিল আমাকে। মনে হচ্ছিল— আমি যেন নকল বুদির গড় সামলাতে নেমেছি। ওই সময় কাউকে পাচ্ছিলাম না যারা আমাকে একটু মরাল সাপোর্ট দেবে।
তবে মরাল সাপোর্ট আমি পেয়েছি। পেয়েছি আমার পরিবার থেকে। পেয়েছি খুব কাছের কয়েকজন বন্ধুর থেকে। আর একজন— আমাদের যমুনা টিভির সিইও ফাহিম আহমেদ, তিনি আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন। তুমি এগিয়ে যাও। সবকিছুর উপরে মানুষ, তাই একজন মানুষ হিসেবে তুমি আগে মানুষের পাশে দাঁড়াও। শুধু উৎসাহিত করেননি, চোখ বন্ধ করে ভরসা করেছেন। আজ যে সুন্দরবন দস্যু মুক্ত হয়েছে, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব কিন্তু আমাদের নিউজরুমের প্রতিটি সদস্যের। তারা ছাড়া এই কাজ সম্ভব ছিল না। সেই সমর্থনটুকু না থাকলে এই কাজটি আর ধরে রাখতে পারতাম না।
আমাকে সেই সময় সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছিলেন ৱ্যাব-খুলনার তখনকার অধিনায়ক। ২০১৬ সালের শুরুর দিকের কথা। সবে দায়িত্ব নেয়া অধিনায়ক পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি খন্দকার রফিকুল ইসলামের সঙ্গে আগে থেকেই কথা চলছিলো। তিনি ভীষণ উৎসাহ দেখালেন। রাজি হলেন। কিন্তু বিস্ময়কর ভাবে শেষ মুহুর্তে তিনি আত্মসমর্পণ নিয়ে নেতিবাচক সিদ্ধান্ত দিলেন। সিদ্ধান্তটি দিলেন আমার টেলিভিশনে, সরাসরি সম্প্রচারের সময়।
ঘটনাটি বলছি।
মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্ৰস্তাব আমরা সাধ্য মতো সংশ্লিষ্ট জায়গায়গুলিতে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। ৱ্যাব রাজি না। তাই আমি চেষ্টা করছিলাম কোস্টগার্ডের সঙ্গে কথা বলে যদি কিছু করা যায়। আমি গিয়েছিলাম কোস্টগার্ডের পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডারের কাছে। উনি সবার মতো আশ্বস্ত করেছিলেন আমাকে। কিন্তু কাজ এগোলো না।
এর পর পর আমি গিয়েছিলাম ৱ্যাব-৬ এর কাছে। পুরো সুন্দরবন এই ব্যাটেলিয়নের অন্তর্গত এলাকা। আগেই বলেছি ৱ্যাব -৬-এর তখনকার অধিনায়ক ছিলেন খন্দকার রফিকুল ইসলাম। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত। দস্যুদের আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া নিয়ে আমরা একসাথে কাজ করেছি কিছুদিন। সেই সময় তিনি বাগেরহাটের এসপি ছিলেন।
নিউজের কাজে সেবার আমি খুলনায় গেলাম। দস্যুদের আত্মসমর্পণের ব্যাপারে যেহেতু কারও সাহায্য পাচ্ছিলাম না, তাই ভাবলাম মাস্টার বাহিনীর নিউজটা আর আটকে রাখার দরকার নেই। হোক প্রচার। সরকার দস্যুদের আত্মসমর্পণে রাজি হচ্ছে না। কিন্তু দেশের লোককে সত্যটা কেন জানাবো না? তারাও দেখুক। জানুক, সত্যি কী অবস্থা বনদস্যুদের। কী অবস্থা সুন্দরবনের মানুষজনের। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। নিউজ প্রচার হলো যমুনা টিভিতে। সে রাতেই যমুনা টিভি-র খুলনা ব্যুরো কার্যালয়ে এসে রাত নয়টার সংবাদে সরাসরি যুক্ত হয়েছিলেন ৱ্যাব- ৬ এর তখনকার অধিনায়ক। সেই লাইভে উনি বললেন, “দস্যুরা এই রকম নাটক সাজায়। এটা করে তারা সুযোগ নেয়। সুতরাং এটা করা যাবে না। “
এই ভাবে লাইভে এসে প্রত্যাখ্যান করলেন দস্যুদের আত্মসমর্পণের প্ৰস্তাব। আমি বিস্মিত হলাম। এমন তো কথা ছিল না!
(ক্রমশ)
Vay u r great parson.love u vay