পর্ব ৩১

(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)

২০০৯। তারপর পেরিয়ে গেল কতগুলি বছর। সেদিন সুন্দরবনের মানুষগুলির অসহায় আর্তি আমার ভেতর নাড়িয়ে দিয়েছিল। আমরা বাঁচতে চাই। জলদস্যুদের হাত থেকে বাঁচতে চাই। আমরা আইলাকে ভয় পাই না, আমরা সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগারকে ভয় পাই না। আমাদের ভয় জলদস্যুদের নিয়ে। মানুষগুলির দুর্দশা দেখে আমি চেয়েছিলাম, জলদস্যুদের কাছে যাবো। তাদের সঙ্গে কথা বলবো। চেষ্টা করবো তাদেরকে নিবৃত করার। মোতালেব, শহীদুল, রাজু— এদের সবার সঙ্গে কথা বলেছি আমি। গেছি প্রায় সব ডাকসাইটে জলদস্যুর কাছে। একটাই আর্জি— আত্মসমর্পণ করুন। এদের অনেকেই তো চেয়েছিল আত্মসমর্পণ করতে। আমি তাদের কথা জানিয়েছি প্রশাসনকে। গেছি সর্বোচ্চ স্তরে। রাজনৈতিক নেতা থেকে আমলা— সবার কাছে। একবার ,দু’বার ,তিনবার। বারবার ব্যর্থ হয়েছি। ফের শুরু করেছি নতুন উদ্যমে।

সারাদিন যমুনা টেলিভিশনে সংবাদ প্রচারের পর রাত নয়টার যে অনুষ্ঠানটি হল, সেটি নিয়ে আমার আশা ছিল অনেক। হয়তো এবার একটা ইতিবাচক কিছু পাবো। পরিবর্তে একঝাঁক নিরাশার মেঘ ঘিরে ধরলো আমাকে। খন্দকার রফিকুল ইসলামের সেদিনের ইন্টারভিউ আমাকে একেবারে ছারখার করে দিলো। বনদস্যুরা এইরকম নাটক অনেক করে। ওদের আত্মসমর্পণ করতে চাওয়া একটা নাটক। সারা বাংলাদেশের মানুষ দেখলো আমার ওই ভিডিওগুলিতে যা দেখানো হচ্ছে, যে ইন্টারভিউ আমি করে এনেছি— সেগুলি সবটাই নাটক। আমার এত দিনের পরিশ্রম সবটাই একটা অভিনয়। এর আগে এত সমালোচনা হয়েছে, এত দুর্নাম হয়েছে আমার, কিন্তু সেদিনের সাক্ষাৎকারের পরে মনে হলো, আমার সবকিছু মিথ্যা। আমি বিস্মিত ও মর্মাহত। আমি থমকে গেলাম। আমার এত দিনের পরিশ্রমের সবটাই পন্ড হল। মনে হল, আর কিছু করার নেই আমার। এবার দাড়ি টানার পালা। এই সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করার চেষ্টা আমার দিক থেকে শেষ। এরপর আর এগোনো যায় না।

রাত নয়টার অনুষ্ঠান শেষ করে আমি বেরিয়ে এলাম অফিস থেকে। রাতের খাবার খেতে হবে। গেলাম খুলনার জিরো পয়েন্টে। রাত তখন বোধ হয় ১০টা পেরিয়েছে। খেতে বসবো। ঠিক সেই সময় বেজে উঠলো আমার ফোন। ৱ্যাবের একটা নম্বর! আমি ফোনটা ধরলাম।

—হ্যালো।

—মোহসীন ভাই।  আমি লেফটেনেন্ট কর্নেল আজাদ বলছি। আমি ৱ্যাবের ডিরেক্টর ইন্টেলিজেন্স।

নিজের পরিচয় দিলেন ফোনের ওপারের ব্যক্তি।

—কি ব্যাপার ভাই! ফোন ,দিলেন কেন? আমি ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম এমন একটা মানুষের ফোন পেয়ে। শুভেচ্ছা বিনিময় হলো।

—আমি আপনার নিউজটা দেখলাম। সবটা দেখেছি। একটা কথা বলুন তো, ওরা কি সত্যি সারেন্ডার করবে? আপনার কি মনে হয়? আমাকে সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন গোয়েন্দা প্রধান।

—হ্যাঁ, ওরা তো ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে সারেন্ডার করবে বলেছে।  আমিও খুব নিশ্চিত। আর এই কারণেই তো ওদের কথাগুলি নিউজে তুলে ধরলাম। কিন্তু আপনারাও তো না করে দিলেন।

—না না, হতাশ হবেন না, আপনি একটু ধৈর্য ধরুন। আমার মনে হয়, আমরা এই বিষয়টি নিয়ে এগোতে পারি। শুনুন, যদি সত্যি সত্যি দস্যুবাহিনী সারেন্ডার করতে চায়, তাহলে আমি চেষ্টা করছি যাতে তারা সেই সুযোগ পায়।

মুহূর্তের মধ্যে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার সারা শরীর জুড়ে। অন্ধকারের মধ্যে একটা আশার আলো। গোয়েন্দা প্রধান নিজে বলছেন চেষ্টা করবেন। ভেতরে ভেতরে কাঁপছি আমি।

—হ্যাঁ আজাদ ভাই, সত্যি সত্যি ওরা আত্মসমর্পণ করতে চায়।

এরপর আমি সব ঘটনা তাঁকে খুলে বললাম। মাস্টার বাহিনীতে কত লোক আছে , কত অস্ত্র আছে— সবটাই তাঁকে বললাম।  

আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত করে তাঁকে বললাম, আমার সঙ্গে যা কথা হয়েছে তাতে এইটুকু বলতে পারি— দস্যুবাহিনী সারেন্ডার করবেই।

—ঠিক আছে। আপনি আপনার কাজ এগিয়ে নিয়ে যান। আমি আছি আপনার সঙ্গে।

আমাকে আশ্বস্ত করলেন কর্নেল আজাদ।

আমি তখন তাঁকে প্রশ্ন করলাম, আমার সঙ্গে সম্বন্বয় করবে কে? দায়িত্ব নেবেন কারা? ৱ্যাবের থেকে কোন উইং কাজ করবে? আমি তো একা এগোতে পারবো না।

—ঠিক আছে।  সেটা আমি দেখছি। হতে পারে, ৱ্যাব -৮ করবে বা আমাদের সদর দফতর থেকেও লোক যেতে পারে। কোনও সমস্যা নাই, আপনি আপনার কাজ শুরু করুন।

এই পর্যন্ত কথা হল গোয়েন্দা প্রধান কর্নেল আজাদের সঙ্গে।

আবার শুরু হবে আমার কাজ। মুহূর্তে পৃথিবী বদলে গেল আমার কাছে! জিরো পয়েন্টে চুঁইঝাল দিয়ে খাসির মাংস বিখ্যাত। আজ ডিনার ওটা দিয়ে হবে। ডিনার করতে বসেছি, সেই সময় আবার বেজে উঠলো ফোন। এটাও তো ৱ্যাবের নম্বর। এই সময় আবার কে ফোন করলো।

-মোহসীন ভাই, আমি মেজর আদনান কবীর বলছি। আমি ৱ্যাব-৮-এর উপ-অধিনায়ক (বরিশাল ৱ্যাবের)।

—হ্যাঁ, আদনান বলো। কি খবর? মেজর আদনান আবার কলেজ ক্যাডেট সূত্রে আমার ছোট ভাই। পূর্ব পরিচিত। আমি আদনানকে তুমি করে ডাকতাম।  

—ভাই, আপনি আর কোথাও দৌড়াদৌড়ি করবেন না। আপনার সঙ্গে আমরা কাজ করবো। আমি কাজ করবো।

—কি বলছো! তুমি কাজ করবে?

—ভাই, আপনি কাল সকাল বেলায় বরিশাল আসতে পারবেন? কিছু যদি মনে না করেন, সম্ভব হলে আপনি এখনই রওনা হন।

—তুমি কেন কাজ করবে?  তুমি তো বরিশালের।  সুন্দরবন তো তোমার এলাকা নয়। সুন্দরবন তো খুলনা ৱ্যাবের অধীনে?

—ভাই জলদস্যুরা তো জেলে অপহরণ করে সাগর থেকে। আমার বরিশাল উপকূল থেকে। আমাকে তো সেটা নিয়েও কাজ করতে হয়। তাই ওই হিসাবে গিয়ে কোনও কাজ নাই। সুন্দরবনের জলদস্যু সমস্যা আমাদের দেশের সমস্যা। আমাদের সবার সমস্যা। আর ভাই, সাগরের কি কোনও সীমা আছে?

ঠিক আমার মনের কথা শুনতে পেলাম আদনানের মুখে। জলদস্যু সমস্যা বাংলাদেশের সমস্যা। আমাদের সবার সমস্যা।  বলতে বাধা নেই, সুন্দরবনের জলদস্যুদের আত্মসমর্পণের প্রসঙ্গ এলে মেজর আদনান কবীরের কথা বলতে হবে। ৱ্যাবের পক্ষ থেকে গোটা বিষয়টি পরিচালনা করেছিলেন তিনি। সেই গল্প পরে হবে।

পরদিন সকালেই আমি পৌঁছে গেলাম বরিশাল।  সময়টা ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাস। আমার নতুন করে পথ চলা শুরু হল। মেজর আদনান আমার পূর্ব পরিচিত। তাঁর প্রতি অগাধ বিশ্বাস আমার। তাঁরও আমার প্রতি বিশ্বাস ছিল। এক সাথে পণ করলাম, সুন্দরবনকে জলদস্যু মুক্ত করবো আমরা। হতোদ্যম হৃদয়ে প্রাণের সঞ্চার হল।

(ক্রমশ)

2 COMMENTS

  1. মহাসিনউল হাকিম স্যার,,,, আপনি হাজার বছর বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায়।

  2. ভাই আপনার প্রতি দিন দিন মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। ভাই ভালোবাসা অবিরাম ভাই ❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️❤️

Comments are closed.