পর্ব ৩৫
মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।
সেদিনটা ২৭ মে। সন্ধে হবে হবে। আমরা মানে আমি, পলিন, ইয়ামিন আলী, বেলায়েত সরদার বসে বিশ্রাম করছি এক জায়গায়। সেই সময় মাস্টার এল আমার কাছে। সঙ্গে সোহাগ আকন। হাতে একটা বাজারের ব্যাগ। আমরা গল্পে মশগুল। ওখানে এসে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো তারা। কেমন যেন একটু ইতস্তত করছে।
—কি হয়েছে ? নতুন কোনও সমস্যা? জিজ্ঞাসা করলাম মাস্টারকে।
মাস্টার কিন্তু তবুও ইতস্তত করছে।
—কি হয়েছে মাস্টার?
আমার চিন্তা আত্মসমর্পণ নিয়ে। ভারছি, আবার কি হল কে জানে, নতুন করে কেউ হয়তো আত্মসমর্পণ করতে চাইছে না।
একটু চুপ থেকে থেকে মাস্টার বলল, ‘‘ভাই আল্লাহ যদি বাঁচায় তাহলে তো আমরা বেঁচে যাচ্ছি। কিন্তু আমি বলছি অন্য কথা। আপনি আমাদের জন্য এত কিছু করলেন, এত বিপদ মাথায় নিলেন। কি করে আপনার ধার মেটাবো? আপনি বলুন আপনাকে কি দিই?
—কি দেবেন ?
— না ভাই। আপনি যদি কিছু মনে না করেন…। মাস্টার আবার ইতস্তত করছে। বললেন, একটা মাছও তো খাওয়াতে পারলাম না আপনাকে।
—শোনেন, যদি সবকিছু ঠিক থাকে, আমি একদিন আপনাদের বাড়ি গিয়ে খেয়ে আসবো। মাস্টারকে বললাম।
বাড়ির কথা শুনে মাস্টারের চোখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল। তাকে দেখে আমার মনে হল, কোথায় সেই ভয়ঙ্কর মাস্টার। বাড়ির নাম শুনে কেমন শিশুর মতো মুখে হাসি খেলে গেল লোকটার। বুঝতে পারলাম মাস্টারের মতো জলদস্যুরাও চায় বাড়িতে ফিরতে, চায় নিশ্চিত জীবন।
—এই নেন।
চমকে উঠলাম আমি। মুহূর্তে মাস্টার তার হাতে থাকা বাজারের ব্যাগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল।
—কি আছে এতে? মাস্টারের জবাবের অপেক্ষা না করে আমি ব্যাগ খুলে ফেললাম। আর ব্যাগটা খুলতেই একটা বিশাল ধাক্কা— দেখি, ব্যাগ ভর্তি সাজানো রয়েছে টাকা।
সেই মুহূর্তে আমার জীবনের অন্যতম আশ্চর্যজনক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি আমি।
—এত টাকা? কেন? কার জন্য? কত টাকা? এক নাগাড়ে প্রশ্ন করলাম মাস্টারকে।
-বেশি না ভাই। ২৫ লাখ টাকা আছে মাত্র। আমরা তো বেশিদিন ডাকাতি করতে পারিনি, সবে মাত্র নেতৃত্বে এসেছি। এই টাকা আপনার জন্য রেখেছিলাম।
কি বলছে এইসব! থমকে গেলাম মাস্টারের কথা শুনে। এটা সম্ভব নাকি কখনও। ২৫ লাখ টাকা ! আমার যেন সব কিছু তালগোল পাকিয়ে গেল। এমনি এমনি কেউ কাউকে এত টাকা দিয়ে দেবে? হয় কখনও! মাস্টারের কথা শুনে আমার সহকর্মীরাও অবাক। আমরা কিছুক্ষণ একে অন্যের মুখের দিকে তাকালাম। কি বলছে মাস্টার!
—কি বলছেন এইসব! এই টাকা আপনি আমারে দিবেন?
—দেখেন ভাই, আমি বেশি দিতে পারছি না। এইটুকুই সম্বল। কতদিন বা লিডার ছিলাম। ওইটুকু জমাতে পেরেছি। মাস্টার আবার টাকাগুলি আমাকে দিতে গেল।
সত্যি বলতে কি, গলার কাছে পাক খেয়ে যেন কিছু আটকে গিয়েছিল। লোকটা তার সর্বস্ব দিতে রাজি। শুধু একটু সাধারণ জীবনে ফিরতে চায় সে। কিন্তু সেই জীবনও তো স্বাভাবিক ভাবে কাটবে না। অনেক কাঁটা বিছানো হবে সেই পথ। এই টাকাগুলি দরকার হবে তখন।
মাস্টারকে বললাম, ভাই আপনাদের মামলা-টামলা, জেল-টেলের খরচ আছে। কি করে চালাবেন ? কতটাকা লাগবে কেউ জানে না। ওই টাকা আপনি রাখুন। অসময়ে দরকার পড়বে। আত্মসমর্পণের পরে তো প্রতিপদে খরচ। সামলাবেন কি করে? তাছাড়া, আপনাদের টাকা আমি নেব কেন?
কিন্তু মাস্টার অনড়। আমাকে ওই টাকা দিয়েই ছাড়বে। কৃতজ্ঞতা।
আচ্ছা! আমি কি করেছি বলুন তো ? আমি তো জলদস্যুদের কথা ভেবে কিছু করিনি। হ্যাঁ, আমি চেয়েছি, জলদস্যুরা সাধারণ জীবনে ফিরে আসুক। সে তো সুন্দরবনের ৩০ লক্ষ মানুষের জন্য। এদের জন্য তো নয়। তবুও কেন এরা আমাকে টাকা দেবে। না, ওই টাকা নেওয়া যাবে না।
আমিও অনড়। টাকা কিছুতেই নেবো না। আবার বোঝালাম মাস্টারকে। টাকা আমি নিতে পারবো না।
সেদিন অনেক কষ্টে রক্ষা পেলাম মাস্টারের হাত থেকে। টাকা না নেওয়ায় দস্যুরা অবাক হলো। ওদের চোখে মুখে দেখলাম একটা অবিশ্বাস। এমনও হয়। কেন জানি আমার মনে হল, আমার প্রতি ওদের বিশ্বাস মুহূর্তের মধ্যে কয়েক গুন বেড়ে গেল। ওদের চলনে বলনে দেখলাম অনেক বেশি আত্মবিশ্বাস।
একটু চুপ করে থেকে মাস্টার বলে উঠলো —টাকাটা আপনি নিলেন না ভাই। কিন্তু ভাই আমাদের যেখানে নেওয়ার নিয়ে যান। এখন থেকে যা বলবেন, যেভাবে বলবেন সেইভাবে চলবো আমরা।
আমি জড়িয়ে ধরলাম মাস্টারকে। এক লহমায় লোকটাকে আরও আপন মনে হল।
স্থির হল, যারা আত্মসমর্পণ করবে তারা আমার কথা মেনেই চলবে। কিন্তু যারা করবে না , তাদের কি হবে?
সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, তাদেরকে নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে। এমন সিদ্ধান্ত মেনে নিল সবাই।
দস্যুদের দু’টি ট্রলার। আমাদের একটি ও জেলেদের আর একটি ট্রলার ছিল। এই চারটে ট্রলার নিয়ে রাত ১০টার দিকে খাওয়াদাওয়া করে আমরা পাশাখালীর ফরেস্ট অফিস থেকে রওনা দিলাম। পশুর নদী ধরে রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ ভদ্রা নদীর গোঁড়ায় গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে একটু আড়ালে থেকে ৱ্যাবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
(ক্রমশ)
দারুণ লাগে আপনার গল্প, সুন্দরবনের গল্প। পরবর্তী প্রকাশের জন্য অপেক্ষা করছি।
অসংখ্য ধন্যবাদ ভাই । ভালো থাকবেন। শুভকামনা
অসাধারণ
মন থেকে আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া।