পর্ব ৪

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন। ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশটিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন। প্রান্তিক মানুষের জীবনজীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন। সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

মোতালেবের মৃত্যু কিছু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছিল আমাকে। একজন জলদস্যুর স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথ কোথায়? সত্যি তো সব পথ বন্ধ। তাঁর পরিবার, তাঁর গডফাদার, প্রশাসন— সবাই চেয়েছে মোতালেবের মৃত্যু। কিন্তু কেউ আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করেনি জলদস্যু সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জলদস্যুদের হিংস্রতায় বিধ্বস্ত হয়েছে অবিভক্ত বাংলা, আর এখন স্বাধীনতার পরে আমার বাংলাদেশ। চেষ্টা করেছেন অনেকে, মুঘল সম্র্রাট শাহজাহান থেকে ব্রিটিশ রাজ— সবাই। কিন্তু বন্ধ হয়নি জলদস্যু বৃত্তি। এই থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট, শুধু ক্রসফায়ার করে, ভয় দেখিয়ে, কিছু মৃত্যুর বিনিময়ে শেষ হবে না জলদস্যুবৃত্তি। কারণ, সমস্যাটা খুব সরল নয়। কিছু লোকের মনে হল, কাল থেকে আমরা জলদস্যু হব— এই ভাবে কেউ জলদস্যু হয় না। একজন লোকের জলদস্যু হবার পিছনে জীবনের অনেক জটিল অঙ্ক কাজ করে। দরকার সেই কারণ অনুসন্ধানের। ঘাটতে শুরু করেছিলাম সেই কারণগুলি। 

ক্রসফায়ারে জলদস্যুদের মৃত্যুর পরে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রশস্ত্র

মারডক ইউনিভার্সিটির ক্যারোলিন লিস লিখেছেন, “দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জলদস্যুতার বিরুদ্ধে লড়াই করা একটি জটিল ও কঠিন কাজ।” তাঁর লেখায় পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছেন তিনি।

কারণগুলি হল— অতিরিক্ত মাছ ধরা, শিথিল সামুদ্রিক নিয়মনীতি, সংগঠিত অপরাধ সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব, রাজনৈতিক ভাবে অনুপ্রাণিত গোষ্ঠীর উপস্থিতি এবং ব্যাপক দারিদ্র্য।  লিস আরও বলেছিলেন, জলদস্যু সমস্যাকে দূর করার জন্য দরকার এই ধরনের সমস্যাগুলির সমাধান করা।

লেখাটি পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল কেউ সমস্যার গভীরে যেতে চাইছেন না। এমনকি, গণমাধ্যমেও সঠিক খবর প্রচারিত হচ্ছে না। মোতালেব মারা গেলেন। কীভাবে? তিনি গেলেন স্ত্রী-র সঙ্গে দেখা করতে। সেখান থেকে তাঁর গডফাদাররা তাঁকে ধরিয়ে দিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে। তারপর ক্রসফায়ারে মৃত্যু। একটা বিষয কিন্তু এই ঘটনাগুলির মধ্যে লুকিয়ে আছে। আত্মসমর্পণ করতে চাওয়াটাই কি কাল হয়েছিল মোতালেবের? তার মানে কি জলদস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সব পথ বন্ধ?

আমি বুঝতে পারলাম, সমস্যার ভিতরে না ঢুকে, কিছুতেই এই সমস্যাকে নির্মূল করতে পারা যাবে না। একজন মোতালেব গেলে, একজন জলদস্যুর মৃত্যু হয়। কিন্তু থেকে যায় সেই বাহিনী। হয়তো আরও বিভক্ত হয়ে ওঠে ছোট ছোট দল ও উপদলে। তাই দরকার জলদস্যুদের কাছে পৌঁছনোর। ওদের সাথে কথা বলা। ওদের বোঝানো— আজ না হয় কাল চরম পরিণতি নেবে আসবে। ক্রসফায়ারে মৃত্যু হবে ওদের।

যে সময়ের কথা বলছি, সেটা ২০১০ সাল। ঠিক করলাম, রাজুর সাথে দেখা করবো। যে দেড় ডজন বাহিনী সেই সময় গোটা সুন্দরবনকে কন্ট্রোল করে, তাদের মধ্যে বড় দস্যুদল তিনটি। রাজুর বাহিনী তার মধ্যে একটি। রাজু সুন্দরবনের দস্যুজগতের মুকুটহীন সম্রাট। এলাকা দখলের লড়াইয়ে সবার আগে সে। সেই সময় রাজুর বাহিনীর কাছে ছিল প্রায় ৩৫টি অত্যাধুনিক অস্ত্র ও বিপুল গোলাবারুদ। একশোরও বেশি দস্যু। আর সেই সঙ্গে চারটি দ্রুত চলমান ইঞ্জিন নৌকা।

কিন্তু কোথায় পাবো রাজুর দেখা। আবার খোঁজ শুরু। পেশাগত কারণে একদিন রাজশাহী যাচ্ছিলাম। পথে অচেনা নম্বর থেকে একটি ফোন এল। পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘‘আমি একজন দস্যু নেতা। রাজু মোল্লা।’’ রাজু মোল্লা! এই দস্যুনেতার সন্ধান পেতে তো আমি কত মাস ধরে অপেক্ষা করছি। কত লোকের কাছে গেছি। কত নেটওয়ার্ক তৈরি করেছি। আজ সেই লোকটি নিজেই ফোন করেছে আমাকে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না আমি।

-কোন রাজু?

-সুন্দরবনের রাজু।

-সুন্দরবনের রাজু! আপনাকেই তো খুঁজছি আমি।

-আমিও আপনাকে খুঁজছি।

শুরু হলো রাজুর সাথে আমার কথাবার্তা।

শুরুতে বেশ রাশভারী কন্ঠে একটু কর্তৃত্ব নিয়ে আমাকে বললেন— আপনি কেন দস্যুদের পিছনে দৌঁড়চ্ছেন? আপনার স্বার্থ কী ? কাহিনীটা কী ভাই?

বুঝলাম নরম গলায় হবে না। একটু বাঁকা উত্তর দিতে হবে।

-আমি আপনাদের ধরিয়ে দিতে চাই। আমি চাই না আপনারা সুন্দরবনে দস্যুতা করেন। আপনারা আজ সুন্দরবনের হাজার হাজার মানুষের অশান্তির কারণ।

সোজাসুজি উত্তর দিলাম আমি।

-আমরা কি যেচে এসেছি এই কাজে! আমরা কেউ শখ করে দস্যুতা বেছে নিই নি। আমরাও শান্তিতে নেই।

সুর নরম করলেন রাজু।

সেদিন বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছিলাম রাজুর সঙ্গে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে দেখা করতে রাজি হলেন তিনি। একটা সম্ভাব্য তারিখ দিলেন। দুই-তিন মাস পরে। সুন্দরবনের গহীনে তাঁর ডেরায় যেতে হবে আমাকে…।

(ক্রমশ)

1 COMMENT

Comments are closed.