পর্ব ৭

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন। ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন। প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন। সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন।

মিনিটখানেক পরে পাশের কেবিন থেকে একটা হাত বেরিয়ে এল। হ্যান্ডশেক করলো আমার সাথে, ছিপছিপে চেহারার তরুণ। এই তাহলে রাজু! অবাক হলাম আমি। এইটুকু ছেলে এতো বড় বাহিনী সামলাচ্ছে! সরাসরি ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। রাজুর চোখদুটো অসম্ভব গভীর। যেন এক লহমায় পুরো ভেতরটা পড়ে নিতে পারে। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা।

রাজু বাহিনীর চারটে ট্রলার। সবচেয়ে বড়ো ট্রলারটিতে রাজুর থাকার জায়গা। সেই ট্রলারটাকে নিজের মতো বানিয়ে নিয়েছে রাজু। অন্য সব সাধারণ ট্রলারের মতো নয়। ট্রলারের দুপাশে মোটা স্টিলের প্লেট দেওয়া। যাতে গুলি ভেতরে ঢুকতে না পারে। অনেকটা বাঙ্কারের মতো করে বানানো। কেবিনের ভিতরে বেশ আধুনিক ব্যবস্থা। ওয়াকিটকি, দূরবীন, বেশ কয়েকটা মোবাইল। একটা হিসাবের খাতাও আছে। রাজু লেখাপড়া জানে না। ওই হিসাবের খাতা দেখাশোনা করে হাসান। ও-ই এদের মধ্যে কিছুটা শিক্ষিত।

প্রথমে কিছু সময় গেল ধাতস্থ হতে। তারপর দু-চার কথা দিয়ে শুরু করে চেষ্টা করলাম সবার সাথে পরিচিত হতে। কথা বলছি ,গল্প করছি, হাসার চেষ্টা করছি কিন্তু লোকগুলি চোখমুখ বলে দিচ্ছে, ওরা আমাকে আন্তরিক ভাবে মেনে নিতে পারেনি। সন্দেহের চোখে দেখছে আমাকে। এর মধ্যে চা এলো। লাল চা। সঙ্গে মধু আর বিস্কুট। পাশে তাকিয়ে দেখি, রাজু শেভ করার জন্য ক্রিম মাখছে। জিলেট ক্রিম। সঙ্গে জিলেট ফিউশন রেজর। বাবা! ওই সমস্ত জিনিস ব্যবহার করার কথা তখনও চিন্তাই করতে পারিনি আমি।   

এর মধ্যে শেষ হল সকালের খাওয়া। এরা দু’বার খাবার খায়। একবার সকালে আর একবার সন্ধেবেলায়। খাওয়া শেষ করে ট্রলার থেকে নেমে ডাঙায় এলাম। মনে পড়লো, আরে বাড়িতে তো খবর দেওয়া হয়নি। রাজুর মোবাইল থেকে ফোন করলাম বাড়িতে। এর মধ্যে ওখানে উপস্থিত জলদস্যুদের কয়েকজনের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। মনে হচ্ছে এরা এখন আর ততটা সন্দেহের চোখে দেখছে না আমাকে। আমিও যেন কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি। এরই মধ্যে সোহেল আর নিজামউদ্দিনকে ডেকে আনলাম আমার কাছে।

রাজুর বাহিনীতে কম করে শ-খানেক লোক। সবাই ঘিরে রেখেছে আমাদের। সবার হাতে অস্ত্রশস্ত্র। এইরকম অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। উপস্থিত সবার সঙ্গে সবে মিশতে শুরু করেছি, সেই সময় এলো কালবৈশাখী ঝড়। বেশ ভয়াবহ পরিস্থিতি! নদী রীতিমতো উত্তাল হয়ে উঠলো। তুমুল বৃষ্টি। মুহূর্তের মধ্যে ট্রলারগুলো ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিল উপস্থিত জলদস্যুরা। আমরা দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়লাম ট্রলারগুলির মধ্যে। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে নদীর উত্তাল রূপ দেখাও কিন্তু একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। 

একটু পরে বৃষ্টি গেল থেমে। তোড়জোড় শুরু হল রাতের খাবারের। দস্যু সর্দারের অতিথি বলে কথা, ভাল কিছু তো খাওয়াবেই। সর্দার মুকুলকে ডেকে বলল হরিণ ধরে নিয়ে আসতে। হরিণের মাংস দিয়েই হোক আজকের ভোজ। হরিণের নাম শুনে তীব্র আপত্তি করলাম আমি। কিছুতেই না! হরিণ শিকার করা যাবে না। মেনে নিল রাজু। কিন্তু তা বলে থেমে যাবে আপ্যায়ন? কখনওই না। ফোন করে কাকে যেন দুটো খাসি নিয়ে আসতে বললো রাজু।

একদিনেই বেশ মিশে গেছি ওদের সঙ্গে। প্রাথমিক আড়ষ্টতা আর নেই। সবাই বেশ খোলামেলা কথা বলছে। অনেকে ফোন নম্বরও দিল। শুনলাম ওদের কথা, কোথায় বাড়ি, কেন এই পেশায় এসেছে— অনেক কিছু। দস্যুর সর্দার নিজেও বেশ মন খুলে কথা বললো আমার সাথে।  

ধীরে ধরে সময় বয়ে যাচ্ছে। আমাদের এবার চলে যেতে হবে। সময় হয়ে এলো। কিন্তু আমার কাজ এখনো হয়নি। সাক্ষাৎকার তো নিতে হবে। এত বড় একটা মিশন যদি নিউজ না হয় তবে পুরোটাই বৃথা। বলেই ফেলাম একটা সাক্ষাৎকার চাই। আমার কথা শুনে গুঞ্জন শুরু হল সবার মধ্যে। কেউ রাজি হয় তো কেউ হয় না। আমি তখন দোদুল্যমান অবস্থায়। সাক্ষাৎকার পাবো কি না কে জানে? শেষপর্যন্ত রাজি হল দস্যু সর্দার। আমি তখন ক্যামেরা বের করে ফ্রেম দেখালাম রাজুকে। ঠিক হল, ক্যামেরা থেকে মুখ ঘুরিয়ে কথা বলবে রাজু বাহিনীর কোনও একজন। পজিশন নিলাম। কিন্তু প্যাচ বাঁধালো আরিফ ! ওই যাকে রাজুর কেবিনে দেখেছিলাম। ও নাকি শুনেছে কম্পিউটারে চেহারা ঘুরিয়ে দেওয়া যায়। ভাবুন একবার। পুরোটাই কেঁচিয়ে দিল।

আবার চেষ্টা! না এমনটা আদৌ হয় না। বোঝানোর চেষ্টা করছি সবাইকে। একটা সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হল। এর মধ্যে রাজু ফোন করল খুলনার এক সাংবাদিককে। রাজু নিজেও বুঝতে পারছে না, সাক্ষাৎকার দেওয়া ঠিক হবে কি না। শেষমেশ রাজু ফোনটা ধরিয়ে দিলো আমাকে। আমি কথা বললাম সাংবাদিকটির সাথে। উনি আশ্বস্ত করায় অবশেষে রাজি হল রাজু। শুটিং শুরু হল। সময় বয়ে গেছে অনেক। অন্ধকার নেমে আসছে চারিদিকে।

আমরা যখন শুটিং-এ ব্যস্ত দু’টো ছাগল নিয়ে উপস্থিত এক ব্যক্তি। আয়োজন হলো মাংস ভাতের। অন্ধকার নদীতে ট্রলারে বসে খাওয়াদাওয়া করলাম আমরা।

রাজুর সাথে সাক্ষাৎকার শেষ। এইবার ফেরার পালা। 

আমি রাজুর জন্য একটা ফতুয়া আর বাহিনীর জন্য কিছু কাঁচা সবজি এনেছিলাম। দেখলাম জিনিসগুলি ওদের খুব পছন্দ হয়েছে। ফেরার জন্য ট্রলারে উঠবো সেই সময় রাজু বাহিনী সম্মিলিত ভাবে বললো, আমাকে কিছু উপহার দিতে চায়। কী উপহার! এই জঙ্গলে কী উপহার দিতে পারবে এই নিয়ে গুঞ্জন শুরু হলো। রাজু এর মধ্যে মুকুলের ব্যাগ থেকে চার-পাঁচটি পাঁচশো টাকার বান্ডিল বের করলো। আমি যে সময়ের কথা বলছি, সেটা ২০১০ সাল। টাকাটা আমাকে নিতে হবে। কি? এতগুলো টাকা ! হয় নাকি কখনও? কিন্তু রাজু মানবে না। নিতেই হবে। অনুরোধে চিঁড়ে ভিজলো না। অবস্থা বেগতিক। অগত্যা গুনে গুনে পাঁচ হাজার টাকা নিলাম আমি। বললাম, কিছু একটা কিনে নেবো আমরা।

আটটা নাগাদ রওনা দিলাম। বাড়ি ফিরতে হবে। পথে আর এক কাণ্ড। আমাদের ট্রলারটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। অগত্যা অন্য একটা ট্রলার আসবে। আর যতক্ষণ না আসছে ততক্ষণ ভেসে ভেসে ট্রলার এগিয়ে যাবে। আমি চুপ করে দেখতে লাগলাম নিকষ কালো আকাশটাকে। যেন আকাশের কোটি কোটি তারা আমার নাগালের মধ্যে। আমি অনুভব করতে পারছি তাদের উপস্থিতি। এদিকে চারদিকের অখণ্ড নিস্তব্ধতা ভেঙে দূর থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝি পোকার ডাক। আর দু-পাশের বনের গাছে গাছে জ্বলছে নিভছে জোনাকির আলো। কী অপরূপ দৃশ্য। যেন একটা স্বর্গীয় পরিবেশ। আমার মনে পড়ছিল -মন মাঝি রে তোর খেয়াতে তুই দিলি যে পাল তুলে। যাবি রে ভেসে…।

কতটা সময় ওই ভাবে উদাস মন নিয়ে চলেছি জানি না। একসময় দেখলাম আর একটি ট্রলার চলে এসেছে। উঠে পড়লাম ওই ট্রলারে।

ফেরার পথে নলিয়ানের কাছাকাছি কোথাও নেমেছিলাম। ফিরতে সময় লাগেনি।

নলিয়ান হলো খুলনা সুন্দরবনের একটি গ্রাম। আদি নাম, নলেন। মূলত নলিয়ান নামের একটি খাল এখানে এসে শিবসার সাথে মিশেছিল। আজ সেই খাল মরে গেছে। কিন্তু রয়ে গিয়েছে নলিয়ান নামটি।

লোকালয় ও সুন্দরবনের মাঝের এই জায়গাটি মূলত একটি প্রবেশপথ। এখানে বনবিভাগের খুলনার এসিএফ-এর কার্যালয়।

বুঝতে পারলাম যতটা ঘুরে আমি রাজুর কাছে গেছিলাম। আদতে ওর আস্তানা অতটা দূরে নয়। আমাদের ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল যাতে কেউ পিছু না নিতে পারে। রাজুর বুদ্ধি আছে। হবেই না বা কেন! নইলে এত বড় বাহিনী চালাতে পারে? যাই হোক, রেকর্ড করা ক্যাসেটটি একবার দেখে লুকিয়ে ফেললাম আমার জুতোর ভিতরে।

লোকালয়ে এসে আমাদের পথপ্রদর্শক সেই মাছ ব্যবসায়ী মজিবরকে রাজুর দেওয়া পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশে।

সম্প্রচার হল রাজুর আত্মসমর্পণ করতে চাওয়ার সেই সংবাদ। নানা মহলে তীব্র সমালোচনা শুরু হলো মোহসীন-উল হাকিমের।

-এই লোকটা ওদের হয়ে দৌড়চ্ছে কেন?

(ক্রমশ)

5 COMMENTS

  1. সমালোচকরা সমালোচনা করবে এটায় স্বাভাবিক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো সমালোচনাই বাংলার এই বীরকে দমাতে পারেনি। যুদ্ধ নয় বিনয় দিয়েও যে যোদ্ধাকে পরাজিত করা যায় আপনি সেটাই প্রমান করেছেন ভাইয়া। সুন্দরবন ঘিরে এখনো অনেক কাজ বাঁকী। আপনি এগিয়ে যান, সাধারন জনতা আপনার সাথে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

    • সমালোচকরা সমালোচনা করবে এটায় স্বাভাবিক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো সমালোচনাই আপনার মতো বীরকে দমাতে পারেনি। যুদ্ধ নয় বিনয় দিয়েও যে যোদ্ধাকে পরাজিত করা যায় আপনি তা প্রমান করেছেন আপনার জন্য সবসময় শুভ কামনা করি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যেন আপনাকে সুস্থ রাখেন

  2. Honorable Mohsinul-ul Hakim I want to hear more. Keep writing brother.
    Proud of you.

  3. অনেকটা দিন পরে একটা রোমাঞ্চকর বই পড়ে অনেক মজা পেলাম

Comments are closed.