পর্ব ১২

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

একটিবার মুদ্রার অন্য পিঠটা দেখা যাক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযানে মৃত্যু হয়েছে অনেক জলদস্যুর। অনেকেই ভেবেছেন এটাই সমাধান। তবে আমি একটা সরল কথা বলি। প্রাথমিক শর্তকে উপেক্ষা করে কোনও সমস্যার সমাধান হয় না। সমস্যা হল, একবার কেউ জলদস্যু জীবনে ঢুকে পড়লে সে নিজে চাইলেও বেরিয়ে আসার উপায় নেই। প্রশ্ন হতে পারে, কেন একজন জলদস্যু বাহিনীতে যোগ দেবে? আগের পর্বেই বলেছিলাম মকবুলের কথা। আজ চেষ্টা করবো একটি সামগ্রিক চিত্র সামনে নিয়ে আসার। যেমন উদাহরণ হিসেবে আমি মাস্টার বাহিনীর মাস্টারের কথা বলতে পারি।

মোস্তফা শেখ। মাস্টার বাহিনীর নেতা। তার নানার বাড়ি ছিল রামপালের কাঁঠালি এলাকায়। সেখানে তার এক মামা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। সেই মামার ছিল চিংড়ির ঘের মানে ভেরি। সেখানে কাজ করতো মোস্তফা। সে ছিল লাঠিয়াল। একদিকে মামার ঘের রক্ষার দায়িত্ব। সেই সাথে অন্যদের ঘেরগুলিকে দখল। অনেকটা মাসলম্যানের মতো। এই মামাই মোস্তফার হাতে অবৈধ অস্ত্র তুলে দিয়েছিল। একদিন বড় একটা ঝামেলা হয় মামার ঘেরে। সেই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে মোস্তফা। মামলা হয় তার নামে। তার পরে মোস্তফা ফেরারি হয়ে যায়। যোগ দেয় জলদস্যুবাহিনীতে। সেখানেও সেই মামা। মামাই মোস্তফাকে রাজুবাহিনীতে ঢুকিয়ে দেয়। মোস্তফা এর পর ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে সুন্দরবনের মাস্টার বাহিনীর সর্বেসর্বা।

যাই হোক, যে কথায় ছিলাম। কেন একজন জলদস্যুতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়? মাস্টারের কাহিনী শুনলেন। এইরকম হাজারো কাহিনী রয়েছে। গ্রামের রাজনীতি, ছোটখাটো অপরাধ, চুরিচামারি। এ থেকেই শুরু হয় বেশির ভাগ জলদস্যুর জীবন। গ্রামের গরিব সাহসী ছেলেদের ঘের মালিক, চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা দেহরক্ষী বানায়, তারপর তাদের দিয়ে দরকারে খুনখারাবি করিয়ে পরিচিত জলদস্যু দলে পাঠিয়ে দেয়। তবে শুধু পলিটিক্স নয়, অর্থনৈতিক কারণও রয়েছে কিছু মানুষের জলদস্যু হবার পিছনে। সুদের কারবার চলে গোটা সুন্দরবন জুড়ে। যারা সুন্দরবনে মাছ ধরে তাদের বেশির ভাগের কিছু সময়ের জন্য টাকা লাগে। তারা সেই টাকা জোগাড় করে সুদখোরদের কাছ থেকে। সেই সময় মহাজনেরা জেলেদের থেকে একটি করে ব্ল্যাঙ্ক চেক রেখে দেয়। কোনও জেলে সুদের টাকা সময় মতো শোধ না করতে পারলে মহাজনরা ব্ল্যাঙ্ক চেকে  ইচ্ছে মতো টাকার অঙ্ক বসিয়ে মামলা করে দেয়। এই মামলাগুলিকে বলে চেকের মামলা। মামলা চলে। হাজিরা দিতে দিতে হাঁফিয়ে ওঠে জেলেরা। একদিকে মামলা, অন্য দিকে পাওনাদারদের হুমকি বাড়িছাড়া করে জেলেদের। কোনও উপায় খুঁজে না পেয়ে অনেক জেলে ফেরারি হয়ে যায়। টাকার সন্ধানে তারা গিয়ে ভেড়ে জলদস্যুদের সাথে। প্রথম প্রথম বিষয়টা থাকে শুধু টাকা শোধ করার জন্য। কিন্তু একবার জলদস্যুবাহিনীতে কেউ যোগ দিলে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। সে আর নিজের এলাকায় ফিরতে পারে না। বাধা পড়ে যায় ওই জীবনে।

এছাড়াও আছে বিশেষ কয়েকটি অপরাধীচক্র। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সক্রিয় অস্ত্র বা মাদক পাচারকারীদের থেকেও কিছু লোক আসে জলদস্যু বাহিনীতে। অস্ত্র বা মাদক পাচার করতে গিয়ে মামলা খেয়ে পালিয়ে চলে আসে জলদস্যুদলে। আর একটি ব্যাপারও দেখেছি, সেটা হল, জেলেদের কেউ কেউ নিজেরাই জলদস্যু বাহিনীতে ঢুকে পড়েছে। এমনকি, সেই বাহিনীর নেতাও হয়েছে। হয়তো মাছ ধরতে গিয়ে তারা ধরা পড়েছে জলদস্যুদের হাতে। হয়তো অনেক মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়ানো হয়েছে তাকে। কিন্তু পরবর্তীতে সে নিজেই গিয়ে যোগ দিয়েছে অন্য একটি জলদস্যু বাহিনীতে। আর কিছু আছে, যাদের আত্মীয়স্বজন জলদস্যু বলে তারাও ভিড়ে গেছে সেই দলে। তবে সেই সংখ্যা খুব অল্প।

আমার সুন্দরবন অভিযান ও জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ নিয়ে একটা বই আছে, তার নাম “সুন্দরবনের জলদস্যুদের জীবনে ফেরার গল্প।” কেন জীবনে ফেরার গল্প ?

না-জীবনের বাসিন্দা ছিল সুন্দরবনের ৩০ লক্ষ মানুষ। সেই সাথে না-জীবনের বাসিন্দা ওই জলদস্যুরাও। একটা সিস্টেম, যা বঞ্চিত করেছে সুন্দরবনের মানুষকে , রক্ত চুষেছে গরিবের। সেই সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ সুন্দরবনের জলদস্যুরা। আমার লক্ষ্য ছিল, সেই কাঠামো থেকে জলদস্যুদেরকে সরিয়ে নেওয়া। যদি পারি! আজ না-জীবন থেকে জীবনে ফিরেছে জলদস্যুরা। না! ভুল হল।  জীবনে ফিরেছে জেলে , মাওয়ালী , বাওয়ালি। জীবনে ফিরেছে ৩০ লক্ষ মানুষ। আজ সুন্দরবনে নেই বেআইনি অস্ত্রের দাপাদাপি। সুন্দরবন এখন বাংলাদেশের কাছে মুক্ত বাতাস। জীবনে ফিরেছে সুন্দরবন।  কাহিনী যত এগোবে জানতে পারবেন কীভাবে।

ফেরা যাক ইলিয়াসের কথায়। 

আগেই বলেছি ইলিয়াস কিন্তু খুব বুদ্ধিমান। রাজুর অধীনে থাকলেও ইলিয়াসের নিজের একটা স্বতন্ত্র পরিচয় ছিল। আমি চেষ্টা করছিলাম কী করে ইলিয়াসের সঙ্গে দেখা করা যায়। আমাকে সুযোগ করে দিয়েছিল রামপালের মাছ ব্যবসায়ী ও স্থানীয় সাংবাদিক হাকিম ভাই। তাকে সঙ্গে নিয়েই আমি  আর কয়েকজন রওনা দিলাম ইলিয়াসের কাছে যাবো বলে। তখন বেলায়েত সর্দারের ট্রলারটি ছিল ছোট। আমরা মোট এগারো জন। ওই ট্রলারে চেপেই রওনা দিলাম।

সেই সফরে আমার সহযাত্রী ছিলেন সাংবাদিক রহমান মাসুদ, ক্যামেরাপার্সন শেখ জালাল আর রামপাল ও মংলার কয়েকজন। আমাদের রান্নাবান্নার  সমস্ত দায়িত্ব বেলায়েত সর্দারের। ও-ই ট্রলার চালাচ্ছে আবার রান্নার দিকটাও দেখছে। একেবারে অল ইন অল। সবাই মিলে এগারো জন। ছোট ট্রলারে ঠিক ভাবে  বসাও যাচ্ছে না। তবে তা নিয়ে আমাদের কোনও অভিযোগ নেই। বেশ কিছুদিন পরে আবার সুন্দরবনের কোলে। সেই আনন্দের কাছে অন্য সব কিছু গৌণ।

চলা শুরু। পশুর নদী পেরিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। যেতে হবে শিবসা নদীর খাল নিশানখালীতে।

(ক্রমশ)