পর্ব ৮
(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন। ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন। প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন। সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন।)
ঢাকায় পৌঁছে অন্য সব কাজ ভুলে ছুটে গেলাম আমার অফিসে। এটিএন নিউজ। মনে হল, একটা কাজ করতে পেরেছি! বাংলাদেশের মানুষ জানতে পারবে, জলদস্যুরা আত্মসমর্পণ করতে চায়। এই খবর সবার মধ্যে প্রচার হওয়া দরকার।
তবে খবরটা প্রচারিত হবার পরে বুঝেছিলাম, একটা মৌচাকে ঢিল মেরেছি। বুঝলাম, স্বার্থ কী জিনিস। সেই সব কথায় পরে আসছি। আগে শোনা যাক সেই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ।
ট্রলার থেকে নেমে বনের মধ্যে একটা জায়গায় আমরা পজিশন নিলাম। আমি, সোয়েল আর নিজামউদ্দিন তৈরি। অন্যদিকে উপস্থিত কয়েকজন জলদস্যু।
না, রাজু রাজি নয় সাক্ষাৎকার দিতে।
আমাকে সাক্ষাৎকার দেবে রাজু বাহিনীর সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড। সবাই ওকে ‘মামা’ বলে ডাকে।
ক্যামেরার দিকে পিঠ দিয়ে ও দাঁড়ালো। আমার হাতে বুম।
-আমাদের এই বাহিনী রাজুবাহিনী নামে পরিচিত। আমি এই দলের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড। রাজুভাই এখন কথা বলবেন না। আপনার যা কিছু বলার আমার সাথে বলতে হবে।
মামা জানিয়ে দিল রাজু কথা বলতে অপারগ। বুঝতে পারলাম রাজুর বিষয়টা। নিজেকে ধরা দিতে চায় না ও।
আমি মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম
-কেন এই পথে?
-পড়াশুনা শেষ করে দোরে দোরে ঘুরে বেড়িয়েছি। কোনও চাকরি পাইনি। তারপর আমার আরেকটা দোষ ছিল, রাজনীতি করলাম। আওয়ামী লীগের যুবলীগের সদস্য ছিলাম। সেই সময় বিএনপি ক্ষমতায়। দেশের রাজনীতি এত অস্থির হল যে আমরা বাড়িতে থাকতে পারছি না। শুধু আমি নই, আমার বাবা-মাও বাড়িতে থাকতে পারছিল না। লুকিয়ে কাটাতে হয়েছে এখানে ওখানে। তারপর আর না থাকতে পেরে যোগ দিলাম জলদস্যু বাহিনীতে। পরিস্থিতি আমাকে দস্যু বানিয়ে দিয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাগুলি বলেছিল মামা। লক্ষ্য করলাম, অনুতাপ কাজ করছে ছেলেটির মধ্যে।
রাজুবাহিনীর কাছে পয়েন্ট টুটু থেকে থ্ৰি নট থ্ৰি রাইফেল, নাইন শ্যুটার এমনকি স্টেনগানও দেখেছি। মূলত প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ের সময় তারা এই অস্ত্রগুলি ব্যবহার করে।
-কত অস্ত্র আছে আপনাদের? প্রশ্ন করেছিলাম মামাকে
-আমাদের কাছে এইরকম ৩৫টি অস্ত্র আছে। আসলে আমাদের বিষাদময় জীবন। কিন্তু তারপরেও এই কাজ করতে হয়। একবার যখন এই পেশায় এসেছি তখন তো করতেই হবে।
মনে হল, আরও কিছু বলতে চায় মামা। বুকের মধ্যে একটা অব্যক্ত যন্ত্রনা টের পেলাম তার কথায়। পরের প্রশ্নটা করতে যাবো, সেই সময় না করা প্রশ্নটিরই উত্তর দিল মামা
-আর পারছি না। আর সহ্য করতে পারছি না. ফিরতে চাই সাধারণ জীবনে, সরকারের কাছে প্রত্যাশী হয়ে বসে আছি সাধারণ ক্ষমার।
-আসলেই কি আপনারা…
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মামা বলল,
-হ্যাঁ। আমরা আসলেই সাধারণ জীবনে ফিরতে চাই। তা না হলে আমরা আপনার সামনে এই ভাবে আসতাম না।
মামার কথায় আশার আলো দেখতে পেলাম। সুন্দরবন স্বাভাবিক হবে। আমাদের দেশের গরিব জেলেদের মুখে হাসি ফুটবে। মামার কাছে শুনলাম, তারা এই জীবন আর কাটাতে চায় না। বছরের পর বছর গহীন বনে পড়ে থাকতে হচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি। স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে যদি সংসার না করতে পারে, তবে কি হবে টাকা দিয়ে?
-বর্তমানে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে ৱ্যাব (RAB) আমাদের যখন যেখানে পায় ক্রসফায়ারে মেরে ফেলে। কিন্তু সবারই তো তার নিজের জীবনের মায়া আছে, সবাই নিজের জীবনকে ভালবাসে। আমরা এদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি নই, সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চাই। আমাদের সাধারণ ক্ষমা করে দেওয়া হোক।
-সরকার সাধারণ ক্ষমা করলে আপনারা সবাই আত্মসমর্পণ করবেন?
-হ্যাঁ, আমরা আত্মসমর্পণ করবো। আমরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছি। এই জলদস্যুর জীবন ভাল না। আমরা চাই আত্মসমর্পণ করতে। তাই আপনাদের কাছে এসেছি।
এইটুকুই কথা হয়েছিল রাজুবাহিনীর সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড মামার সঙ্গে।
আজ যারা সুন্দরবনের জলদস্যু হিসেবে পরিচিত, তাদেরও একটি সুন্দর শৈশব ছিল। ছিল সুন্দর অতীত, ভবিষতের স্বপ্ন। ইচ্ছে ছিল ভাল কিছু করার। কিন্তু পরিস্থিতি তাদের জলদস্যু বানিয়েছে। এরা ফিরতে চায়। চায় আত্মসমর্পণ করতে। চায় সরকারি ক্ষমা। যখনই সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করবে, সেই মুহূর্তে তারা ছেড়ে দেবে জলদস্যুর পেশা।
সম্প্রচারিত হল সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণ করতে চাওয়ার প্রথম সাক্ষাৎকার।
অনন্ত দিনের অপেক্ষা। তারপর টানা দু’দিন পরিশ্রম। আমার চিন্তা শুধু একটাই, এই সাক্ষাৎকার নিশ্চয় একটা বার্তা পৌঁছে দেবে জনসমাজের মাঝখানে। কেউ হয়তো আমার প্রশংসা করবেন, কেউ আবার সমালোচনা করবেন। তবে আমি যেভাবে বিষয়টিকে ভেবেছিলাম, তাতে প্রশংসা বা সমালোচনা— কোনওটারই তেমন গুরুত্ব ছিল না আমার কাছে। আমি আমার কাছে শতভাগ পরিষ্কার ছিলাম। আমি দেখতে চাইছিলাম, আমার দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিক্রিয়া ঠিক কী হয়? তারা পুরো বিষয়টি কীভাবে নিতে চাইছেন? দস্যুদের আত্মসমর্পণের বার্তা কি তারা সদর্থক হিসেবে নেবে, নাকি …
এতসব ভাবনার মধ্যে বেজে উঠেছিল আমার ফোন। ফোন করেছেন একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মিডিয়ার দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা।
-আপনি কেন এটা করেছেন ? কোনও রকম ভূমিকা ছাড়াই আমাকে প্রশ্ন করলেন তিনি। গম্ভীর গলায় যেন একটু হুমকির মতোই শোনালো তাঁর গলা।
-এর জবাব তো আমি আপনাকে দেব না। সাংবাদিকতায় এমন হুমকি অনেকবার শুনতে হয় আমাদের।
-আপনি এই কাজটি করেছেন, আমাদের জিজ্ঞাসা করেননি কেন?
কথাটা শুনে একটু হাসি পেয়ে গেলো আমার। আপনি আমার এডিটর নাকি? আর আপনি কে আমাকে এই ধরনের কথা বলার?
এরপর ফোনটি রেখে দিলেন তিনি। আর আমাদের মধ্যে বেশি কথা এগোয়নি।
যাই হোক, আমার সমালোচনা হল বিস্তর। কাছের অনেক সাংবাদিক বন্ধু আমাকে মনে করানোর চেষ্টা করালেন, আমি সাংবাদিকতার বাইরে গিয়ে কাজ করছি। কেউ কেউ খুঁজতে শুরু করলেন আমার স্বার্থ। মনে মনে হেসেছিলাম। তবে ওই সাক্ষাৎকারের পরে ইতিবাচক সাড়া না পেলেও আমি হাল ছেড়ে দিইনি।
গেলাম ওই সময়ের স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের কাছে। গেলাম পুলিশপ্রধানের কাছে। সবাই আমাকে মৌখিক আশ্বাস দিলেন। কিন্তু পরে তাঁদের কার্যকলাপে বুঝতে পারলাম, আমাকে তাঁরা প্রত্যাখ্যান করছেন। দস্যুদের আত্মসমর্পণ নিয়ে কোনও ভাবনা তাঁদের মাথায় নেই।
জানতাম কাজটা সহজ নয়, ওই প্রত্যাখ্যান আমাকে দমাতে পারেনি। হ্যাঁ, হয়তো আজ হয়নি, কাল হবে। সময় লাগবে। আমি কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাবো।
রাজুবাহিনীর সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছিলাম ২০১১ সালে। তারপর কেটে গেছে আরও কিছু বছর। আমিও চেষ্টা করে যাচ্ছি আমার লক্ষ্যে। আর যত চেষ্টা করছি তত সামনে আসছে প্রতিবন্ধকতা। পর্দা উন্মোচিত হচ্ছে আমার সামনে থেকে। একটা বড় নেক্সাস। সবাই জড়িত সেই ষড়যন্ত্রে। জলদস্যু, সাংবাদিক,আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ব্যবসায়ীদের অনেকেই। আমি ওদের পথের কাঁটা। ওদের এত বছরের সাজানো বাগান শুকিয়ে যাবে আমি যদি আমার কাজে সফল হই। আমাকে তো দশচক্রে ভূত বানাতেই হবে।
কিন্তু আমি এত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নই। তবে একটি কথা জানিয়ে রাখি। সাক্ষাতকারটি প্রকাশের কয়েক মাস পরে সেই মামা (হাসান। রাজু বাহিনীর সেকেন্ড ইন কম্যান্ড) ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছিলেন।
(ক্রমশ)
আমার দেখা অত্যন্ত সৎ ও দুর্দান্ত সাহসী একজন মানুষ মোহসীন উল- হাকিম ভাই। সুন্দরবন ও এর উপর জীবিকা নির্বাহ করে লক্ষ লক্ষ মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র আপনি। অনেক ভালবাসা,দোয়া ও শুভকামনা আপনার জন্য প্রিয় ভাই। আপনার অবদান অনন্তকাল ধরে এদেশের মানুষ মনে রাখবে।