সাধারণত পুলিশের হেল্প নেওয়াটা এই ডিপার্টমেন্টে দরকার পড়ে না। নিজেদেরই উর্দি, সেপাই শাস্ত্রী, অস্ত্র অবধি আছে। তবু, সাবধানের মার নেই। ড্রাগস কেসে লোক হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠতে পারে। মারপিট, গোলাগুলি— এসব হলে প্রশ্ন উঠতেই পারে। সে সব ভেবে, কলকাতায় অফিসাররা পুলিশি ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। সেগুলো সব গুছিয়ে, চারপাঁচটা গাড়ি নিয়ে বেরুতে বেরুতে সাড়ে তিনটে। দু’টো জায়গা ঠিক করেছিল অমিত। একটা শ্রীপতি মিশ্রের হোটেল আর একটা তার বাড়ি। আরও অনেক জায়গা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে— কিন্তু সেগুলোতে গিয়ে লাভ হবে না। তিনদিন হয়ে গেছে। এর পরেও যদি বাড়িতে, দোকানে প্রমাণ সাজিয়ে বসে থাকে, তাহলে বুঝতেই হবে লোকটি আদতে একটি গাড়ল। না, প্রমাণ কিছুই থাকার কথা নয়।
শুধু একটা কিছু… কোনও ভাবে যদি রাজেশের সাথে যোগসূত্র বার করে নেওয়া যায়, তাহলে…। তাহলেই তাকে অ্যারেস্ট করে ট্রানজিট রিমান্ড পাওয়া যেতে পারে। পেলে, এনে মুখোমুখি বসিয়ে, “সচ উগলানোর” একটা চেষ্টা চালানো যায়। একটা পাতে দেওয়ার মত গল্প, জজ সাহেবের দরবারে পেশ করা যায়। তারপর কি হবে? যা খুশি হোক গে, অমিতের সেটা দেখার কথা নয়। দেখবেও না।
একটু ভেবে, যে টিমটা হোটেলে যাচ্ছে, অমিত সেটায় ভিড়ে গেল।
প্রায় চারতলা বাড়ি। তার দু’টি তলায় হোটেল। সব মিলিয়ে প্রায় কুড়িটি রুম। মোটামুটি মাঝারি সাইজের রুম। অনেকগুলোয় আলো অবধি ভাল করে ঢোকে না। তেমনি রেস্টুরেন্টও নেই। তবে বোর্ডাররা খেতে চাইলে, কিচেন আছে, সেখান থেকে বানিয়ে দেওয়া হয়। কেয়ারটেকার ভদ্রলোক বললেন, ব্রেকফাস্টটাই লোকেরা করে। রাতে অল্প খায়। সবাই এখানে কাজেই আসে। দুপুরে বাইরে খায়।
ভদ্রলোক বয়স্ক। হোটেল কেনা হয়েছে, বছর পাঁচেক হল। ভাড়াটিয়া শুদ্ধ পুরো বিল্ডিংটাই কিনেছে মিশ্র একই সঙ্গে। উঠানো যায়নি। কেস চলছে। ভদ্রলোক আগে পাটনায় অন্য কাজগুলো দেখতেন। হোটেল কেনার পর, মিশরাজী ওনাকে নিয়ে এসেছে। একলা, পরিবার নেই। তাই চলে এসেছেন।
স্টেটমেন্ট নিতে নিতে অমিত শুধালো, ইচ্ছে হলে আপনার চেনা জানা কাউকে তো রাখতে পারেন। ধরুন, বাইরে থেকে এসেছে। রুম তো খালিই থাকে।
বললেন, আমার তো এরকম চেনা জানা কেউ নেই। তাছাড়া রোজ বাবু হিসেব নেন। খাতা পাঠাতে হয়। টাকাপয়সা সব পাঠিয়ে দিই। ব্যাঙ্কে জমা, অন্য গরমেন্ট অফিসের সঙ্গে সব কাজ বাবুই দেখেন। আমার কাজ, দিনেরটা দিনে করে, প্রত্যেক দিন রাতে হিসেব পাঠিয়ে দেওয়া। বছর শেষ হলে, সব খাতা চলে যায় বাবুর সিএ-র অফিসে।
ভাল মানুষ। চা খাওয়ালেন। সঙ্গে সেঁকা পাউরুটি আর অমলেট।
স্টেটমেন্ট নিয়ে, রোজকার হিসেবের খাতা, বিল বই এগুলো জব্দ করে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই কাজ সেরে বেরিয়ে পড়ল অমিত। একটু যেতে হল সিএ সাহেবের অফিসে। সেখান থেকে গতবছরের খাতা ,বিল বই নিয়ে বেরুতে বেরুতে ফোন এলো দ্বিতীয় টিমের। বাড়িতে বিশেষ কিছু নেই। নগদ হাজার দশেক টাকা আছে। বউয়ের কিছু সোনা দানা আছে। তবে এগুলো ইনকাম ট্যাক্স ফাইলে ডিক্লারেশন দেওয়া আছে। বউয়েরও নিজস্ব ব্যবসা আছে। ভালই রোজগার ফাইলে।
ওসব সিজ করার কোনও মানে হয় না। তবে একটা স্টেটমেন্ট নিতেই হবে শ্রীপতি মিশ্রের। সুতরাং তাকে অফিসেই নিয়ে আসতে হয়। তারপর ছেড়ে দিলেই হবে, দরকার না থাকলে।
অমিতদের টিম পৌঁছবার একটু পরেই দ্বিতীয় টিম পৌঁছে গেল।
টায়ারিং আউট বলে একটা সিস্টেম, অমিত খুব পছন্দ করে। লোকটাকে সাধারণ প্রশ্ন করে করে বিরক্ত করে দাও। ছেলের ডাক নাম, বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে শুরু করে স্কুল জীবনের বন্ধু… কিছুই প্রশ্নের আওতা থেকে বাদ যাবে না। প্রশ্নকর্তাও টায়ার্ড হয়। সে বদলে যেতেই থাকে। শুধু উত্তর দেন যিনি, তিনিই কনস্টান্ট থাকেন। অনেকসময় রেগেমেগে, নিজের স্ট্যাটাস, উঁচু কোন সব লোকেদের সঙ্গে পরিচয় আছে, সব জানিয়ে ফেলেন।
কলকাতার টিম মেম্বারদের স্টেটমেন্ট নিতে বলে, অমিত সঙ্গে আনা কাগজপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মোটামুটি একটা লাইন ধরিয়ে দিয়েছে প্রশ্নকর্তাদের। বাকিটা ওরাও জানেন। জিজ্ঞেস করলেন, কটা অবধি? অমিত হাতের আঙুল দেখিয়ে বলল, দশটা। তারপর ডিনার ব্রেক এক ঘণ্টা। তারপর আবার।
দশটা নাগাদ সেই রুমে ঢুকে দেখা গেল, বেশ গরম গরম আবহাওয়া। লোকটির হয়ে একজন উকিল বিকেল থেকেই ছিলেন। এখন আরও একজন মোটা মতো লোক এসে উপস্থিত হয়েছেন। এক ফাঁকে, অমিতকে একজন জানিয়ে দিলেন, তিনি স্থানীয় কাউন্সিলার। বাইরে ছেলেপুলেরা অপেক্ষা করছে।
এসব হয়েই থাকে। লোকটার ক্ষমতা দেখে নেওয়া দরকার ছিল।
এক ফাঁকে অমিতকে বাইরে ডেকে , কাউন্সিলার বেশ মিষ্টি করেই লোকটির উপযোগিতা বুজিয়ে দিলেন। সব শুনে টুনে, অমিত বললো, সে সব ঠিক ঠিক দেখে নেবে। তবে কেসটা ড্রাগের। আর সংবাদপত্র থেকে এরকম সময়টায় কেউ কেউ আসেন, কিছু নিউজ আছে কিনা জানতে। এমনি তো কিছু বলা হয় না, কিন্তু কাউন্সিলার জাতীয় লোক দেখতে পেলে নিউজ করে দিতে পারে।
ব্যাপারটা একটু দেখবেন, বলে সদলবলে একটু তাড়াতাড়িই ভদ্রলোক বিদায় নিলেন। বিদায় নেওয়ার সময় অমিত আবার হাত ঝাঁকিয়ে দিলো, তার কোন কাজ হলে, তিনি সাহায্য করবেনই এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতে ভুললো না।
এবার উকিল। ভেতরে ঢুকে তাকেও ডিনার খাওয়ানো। খাইয়ে মিষ্টি করে, বাইরের বেঞ্চে বসে সারারাত মশার কামড় খাওয়ার নেমন্তন্ন দেওয়া অথবা সকালে আসতে বলা। তিনিও অবশ্য দ্বিতীয়টি বেশি পছন্দ করলেন।
এতক্ষনে অমিত শ্রীপতি মিশ্রকে ভাল করে দেখল। গোলগাল চেহারা। কালোই বলা চলে। সাফারি সুট পরনে। চুলগুলো ছোট করে কাটা। চিরুনি না চালালেও হয়। সিথি নেই। অনবরত গুটখা খেয়ে যাচ্ছে। মুখ থেকে সেটার গন্ধ সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে। কথা বললেও আশপাশ গন্ধে আমোদিত।
লোকটা অবশ্য একদম ঘাবড়ে যায়নি। মুখে বিরক্তির ছাপ, চাপার চেষ্টা নেই।
কাগজ কলম টেনে বসতেই লোকটা একটা স্রাগ করলো। “আরও প্রশ্ন আছে নাকি ? “
মাথা নাড়লো অমিত। তারপর টেপ অন করলো। সঙ্গে কাগজ কলম। বললো, যে প্রশ্নগুলো করছি সেগুলো লিখেও দেব। আপনাকে উত্তর লিখে দিতে হবে।
লোকটা বললো, আমি কিন্তু বাংলা ভাল জানি না। বলতে পারি। হিন্দিতে লিখলে হবে?
– হবে।
প্রথম সব সাধারণ প্রশ্নই। কবে থেকে ব্যবসা শুরু , কিসে আজকাল সব থেকে বেশি রোজগার হয় ।
জানা গেল, প্রথমে দোকান ছিল। তারপর ছোটখাটো কন্ট্রাক্ট। তারপর রেস্টুরেন্ট, হোটেল। ভাল রোজগার হোটেল , বলতে গেলে রেস্টুরেন্ট থেকেই। কলকাতা, পাটনায় রেস্টুরেন্ট আছে। আরো একটা দু’টো খুলবেন ভাবছেন ।
এবার কর্মচারীদের নিয়ে কিছু প্রশ্ন। বললেন, কলকাতার হোটেলের ম্যানেজার অনেক পুরনো লোক। প্রায় পনের বছর ধরে আছেন। আজ অবধি একটা পয়সা এদিক সেদিক করেননি।
– কোনওদিন না?
– না। প্রতিদিন হিসেব করে আমদানি পাঠিয়ে দেন। কত লোক থাকলো , খাওয়ার হিসেব পাঠান।
– উনি তো কাউকে লুকিয়ে রাখতে পারেন। ধরুন, তার কাছ থেকে পয়সা নিলেন কিন্তু আপনাকে বললেন ওনার নিজের লোক। বিনা পয়সায় থেকেছে। হতেও পারে। আজকাল কাউকে বিশ্বাস নেই।
মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে গেল শ্রীপতি মিশ্রের। তারপর বললেন, আপনি বোধহয় ব্যবসা কখনও করেননি। করলে এমন বলতেন না। আমরা কর্মচারীদের বিশ্বাস করি। কিন্তু অনেকগুলো কর্মচারী থাকে। যদি কেউ থাকে, খায়, তার হিসেব অন্যদের কাছ থেকেও পাওয়া যায়। সবার চেনাজানা এসে লুকিয়ে থেকে গেলে…ওই রকম চলতে দিলে তো ব্যবসা লাটে উঠবে। রোজ না হলেও, আমি রেগুলার হিসেব রাখি।
– মানে, নেক্সট কলকাতায় এসে, এই হোটেলে থাকতে হলে আপনাকে বললেই শুধু ডিসকাউন্ট পাওয়া যাবে?
— আরে, কি যে বলেন স্যার। বি মাই গেস্ট। কেন পয়সা দেবেন। আমার গেস্ট রা একদম ফ্রিতে থাকেন।
অমিত আবার জিজ্ঞেস করলো, শুধু আপনার গেস্টরাই তাহলে থাকতে পারেন এই হোটেলে?
– হ্যাঁ।
আবার কিছুক্ষণ অন্য টুকটাক কথা। তারপর সরাসরি প্রশ্ন।
– আপনি রাজেশ প্রসাদকে চেনেন?
– না। কে রাজেশ প্রসাদ?
– চেনেন না বলছেন। অথচ সে তো বললো আপনার আদমি আছে?
– না। না।
খুব জোরেই বললেন শ্রীপতি মিশ্র। এরকম কাউকে আমি চিনি না।
– কিন্তু রেকর্ড তো সেরকম বলছে না, মিশ্র সাহেব। আপনার কলকাতার হোটেলের রেকর্ড বলছে, রাজেশ প্রসাদ বেশ কয়েকবার এখানে এসে থেকেছে। তার আইডি প্রুফ দেখলাম যেন।
– দেখুন, কত লোক এসে থাকে। সবাইকে আমি চিনি না। চিনবো কি করে?
— ঠিক। চেনার কথা নয়। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে, সে কোনওবারই দেখলাম, হোটেলের বিল মেটায়নি। এক-দুদিন নয়, বেশ কয়েকবার ছিল। একবার দেখছি পাঁচদিন অবধি ছিল। তখনও মেটায়নি। একটু আগেই যে বললেন, শুধু আপনার গেস্টকেই ফ্রিতে থাকতে দেওয়া হয়। না, ব্যাপারটা আপনাদের দু’জনকে মুখোমুখি বসিয়েই দেখতে হয়। তো মিশরাজি কালকে চলুন আমার সঙ্গে। ওখানে রাজেশ প্রসাদকে দেখলে হয়তো আপনার মনে পড়তেও পারে। একটু গপশপ করে আসবেন।”
(ক্রমশ)