পর্ব ৪৪
(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)
সাতক্ষীরা সুন্দরবনের গহীন বন। সেখানে আলম বাহিনীর সঙ্গে দেখা। তাদের নিয়ে আসবো সেখান থেকেই। ওখানে আমাদের পুরো দিনটা থাকার কথা ছিল। ঠিক ছিল ওই দিন গভীর রাতে আলম বাহিনীর সব সদস্যকেই সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জের ফরেস্ট ক্যাম্পের জেটিতে নিয়ে আসব। ৱ্যাবের কর্মকর্তাদের হেফাজতে দেয়া হবে। আর শান্ত বাহিনীর আত্মসমর্পণ করানোর কথা তার পরের দিন। কারণ, অনেকটা পথ অতিক্রম করে আমাদের পৌঁছতে হবে পূর্ব সুন্দরবনে শান্ত বাহিনীর কাছে। এক দিনে দু’টো কাজ সম্ভব নয়। তাই ঠিক করেছিলাম শান্ত বাহিনীর আত্মসমর্পণের কাজটি আলম বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরের দিনই হবে। কিন্তু শান্ত বাহিনী গোটা আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব না দেওয়ায় ঘটে গেল এক মারাত্মক দুর্ঘটনা।
দুপুরের পর পর আমি খোঁজখবর পেতে থাকলাম, শান্ত বাহিনী সেলা নদী ধরে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। আসলে শান্ত বাহিনী গোটা বিষয়কে একটু হালকা ভাবে নিয়েছিল। ভেবেছিল আমরা তো আত্মসমর্পণ করতেই যাচ্ছি। ফলে আমাদের আর কেউ কিছু করবে না। খবর শুনে আমি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। ঠিক আত্মসমর্পণের পূর্বমুহূর্তে যদি এমন একটা ঘটনা ঘটে যায় তবে একটা নেগেটিভ বার্তা যেতে পারে। এমন প্রচার হতে পারে আমি আগে থেকে প্রশাসনকে খবর দিয়েছি। পুরো আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়ার উপরে একটা মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। সুন্দরবনের বাকি দস্যুদলগুলি ভয় পেতে পারে, ভাবতে পারে পুরোটাই একটা ষড়যন্ত্র। তাই আমি আর দেরি করলাম না। ভেবেছিলাম আলম বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে এক বেলা সময় কাটাবো সেখানে, রান্নাবান্না হবে, খাওয়া দাওয়া হবে। কিন্তু সে সব মাথায় উঠলো। ওই দিন দুপুরে আলম বাহিনীর সবাইকে নিয়ে উঠে পড়লাম ট্রলারে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। দীর্ঘদিন দস্যুদের সঙ্গে থেকে তাদের ব্যবহারে একটা জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে ছিল— আজ না হোক কাল সব দস্যুদলকেই আত্মসমর্পণ করতে হবে। তাই বৃথা কেন এই জটিলতা !
মুন্সিগঞ্জে আলম বাহিনীকে ৱ্যাবের হাতে তুলে দিয়ে শান্ত বাহিনীর কাছে যাবার জন্য আমাদের যাত্রা শুরু হলো। মুন্সিগঞ্জ থেকে সড়ক পথে এলাম মংলায়। প্রায় ছয় ঘণ্টা লেগে গেল মংলা পৌঁছতে। মংলা থেকে বরিশাল ৱ্যাব এর দল ও আমরা ট্রলারে উঠে বসলাম। সন্ধের দিকে যখন রূপসা নদী পার হচ্ছি— সেই সময় জানতে পারলাম, শান্ত বাহিনীর উপর প্রশাসন আক্রমণ করে ফেলেছে। খবরটা শুনে আমি ভীষণ নার্ভাস হয়ে গেলাম। ঘনঘন ফোন করতে শুরু করলাম বারেককে। আর যত যোগাযোগ ছিল সবাইকে। কিন্তু কাউকে ফোনে পাচ্ছিলাম না। কি করবো এখন? দাঁড়িয়ে থাকা তো যাবে না। আমরা ট্রলার এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করলাম। অনেক ক্ষণ পর বারেক তালুকদারের এক সহযোগী মনিরের ফোন পেলাম আমি। বললেন— ‘‘আমি গাছের মাথায় উঠে আপনাকে ফোন করছি। কোস্টগার্ড (পরে জানা গেছে সেটি ছিল বন বিভাগের অভিযান) হামলা করেছে। গোলাগুলি হয়েছে। ওরা আমাদের নৌকা নিয়ে চলে গেছে। আমি ও বারেক দু’জনে আছি , বাকিরা কোথায় জানি না।’’
আমি বললাম, ‘‘খুঁজতে থাকেন। আর আধঘন্টা পর পর ফোনে আপডেট দেবেন।’’
উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার মধ্যে সময় কাটতে লাগলো আমার। তবে তারা রাত দুটো -আড়াইটার মধ্যেই দলের সবাইকে এক জায়গায় নিয়ে এলো। তখন তাদের কাছে কিছু নেই — শুধু পরনের কাপড় ও অস্ত্রগুলি ছাড়া।
আমার সেখানে পৌঁছলাম ভোর রাতে। সাড়ে তিনটে চারটে হবে। সেলা নদীতে গিয়ে বড় ট্যাংরা খালের পাশ থেকে শান্তবাহিনীকে আমরা উঠিয়ে নিলাম। দেখলাম, ওদের সবার অবস্থাই বড় করুণ। সবার জামাকাপড়ই ভিজে, ছেঁড়া, কাদামাখা। বনের মধ্যে লুকোতে গিয়ে দেহে কাঁটা বিঁধে আছে। নানা জায়গায় অনেক আঘাত পেয়েছে ওরা। দুপুর থেকে পেটেও কিছু পড়েনি।
আলম ও শান্ত বাহিনী হল আমার মাধ্যমে তৃতীয় আত্মসমর্পণ। ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এই দুই দলের ১৪ জন সদস্য ২০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ-সহ আত্মসমর্পণ করে।
(ক্রমশ)