(ড্রাগ চক্রের পিছনে ছুটে বেড়ানো সঞ্জয় গুপ্ত-র কাজ। মাদক চক্রের অপারেশন নিয়ে তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস ‘একটি অসমাপ্ত কাহিনী’। প্রকাশিত হবে মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিবারে।)
রাতে বিশেষ কিছু করার ছিল না।
ফর্সা পোশাক পরা লোকটা বলেছিল, তাকে ছেড়ে দিলে , সে হেঁটে হেঁটে বাস স্টেশনে চলে যাবে। সকালে লাইন বাস ধরে কালিয়া গ্রাম চলে যাবে। দুটো জোরে ধমক দেওয়ায়, আপাতত মুখ গোজ করে চেয়ারে বসে আছে। পেন্টে পাওয়া গেসলো নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা। বললো , মাল কিনতে এনেছে।
ড্রাইভার আর হ্যান্ডিম্যান দুজনেই পাহাড় বাসী। ভালো করে হিন্দি বলতে পারছে না। বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তরেই মুখে কুলুপ লাগিয়ে বসা। দু চারটে চর থাপ্পড় দেওয়া হয়নি যে তা নয়, কিন্তু দ্বিতীয় রেজিস্ট্রেশন লাগানো নাম্বার প্লেট কেন গাড়িতে, তার উত্তর নেই। রেজিস্ট্রেশন বইতে অবশ্য গাড়িতে লেগে থাকা নাম্বারটি নয়, এই কাজে না লাগানো সমতলের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার। কেন পাহাড়ি রাজ্যের নাম্বার লাগানো, এর উত্তরে বলেছে, তাহলে রাস্তায় হূজ্জুতী কম ফেস করতে হয়, আইন রক্ষকদের।
কেসটা খোলসা হচ্ছে না। অমিত ভাবছিল, সকালে ডিস্ট্রিক্ট ট্রান্সপোর্ট অফিসে গছিয়ে দিলেই ভালো হয়। তবে, তার আগে সকালে একবার ফের গাড়ি তল্লাশি করে নিতে হবে।
রাত জাগাটা সবারই অভ্যাস আছে এই ইউনিটে। আর এক প্রস্থ ব্রিজ খেলা হয়ে গেল। প্রচুর সাবধানতা সত্ত্বেও, গোহারান হেরে, সকালের জন্য ব্রেকফাস্ট আনার টাকা অমিতের টিমকেই বের করে দিতে হলো। পরোটা সবজি আর একটা করে বড় সাইজের রসগোল্লা। মায়, নতুন অতিথি তিনজনের জন্যেও।
গরম কাল। সকাল হতে না হতেই রোদ চর চর করে আকাশে উঠে পড়েছে।
বেশ বড় পাঞ্জাব বডি ট্রাক। চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল সবাই। এমন কিছুই নেই। সেই রাতে যা দেখেছিল তাই। দীপঙ্কর দা বললো, এক কাজ করা যাক তেরপালটা খুলে ফেলা যাক।
বলার যা অপেক্ষা। অরুন এক লাফে ট্রাকের ,ড্রাইভারের দিকে ছাদে। তারপর হ্যান্ডিম্যান কে ডাকাডাকি। অনিচ্ছুক ড্রাইভার ও উঠলো। ঘন্টা খানেক লাগলো পুরো তেরপাল খুলতে।
এবার আবার পুরো ট্রাক ঘুরে ঘুরে দেখা। কিছু একটা খটকা লাগছে। কিন্তু কি?
অনেক বছরের পুরনো অভিজ্ঞতা বিভাসদার। তিনিও দেখছেন। দেখতে দেখতে বললেন, আচ্ছা, ড্রাইভার এর কেবিনটা একটু ছোট ছোট লাগছে না?
ভালো করে, ভেতরে ঢুকে কেবিন দেখলো অমিত। সাধারণত এই ধরণের গাড়ি দূরপাল্লার সফরে যায়। ড্রাইভারের পেছনের সিটে, তাই ঘুমোবার জন্যে ,রেলের মত বাঙ্ক থাকে। বেশ একটু জায়গা নেয় সেটা।এই গাড়িতে নেই। তার বদলে বসার ব্যবস্থা আছে।
অথচ বাইরে থেকে দেখলে, একদম নর্মাল সাইজের ট্রাকই লাগে। সবাইই দেখছে। একফাঁকে অমিত টেপ আনতে বললো। একটু মেপে দেখা যাক।
বাইরে থেকে, ড্রাইভারের কেবিন থেকে পেছনের সীমানা অবধি, যেখানে কেবিন শেষ হয়েছে সেটা যতখানি লম্বা, ভেতরে কিন্তু ততটা নয়। এতখানি জায়গা গেল কোথায়?
এবার গাড়ির পেছন দিকের ডালা ধরে, উঠে এলো অমিত। যেটা দেয়াল হিসেবে কাজ করে, ড্রাইভার কেবিন আর পেছনের মাল রাখা জায়গার সাথে, সেখানে লাগানো এলুমিনিয়ামের শিটটি পরখ করে দেখা। একটু জোরে জোরে হাতুড়ির ঘা। কেমন যেন একটা শব্দ। অরুন কে বলল, খুলে ফেলতে। খুলতে গিয়ে দেখা গেল, শিটটি আদতে বেশ কয়েকটা স্ক্রু দিয়ে লাগানো। তিনটে পিস হিসেবে লাগানো। প্রথমে খুলতে হলো দুদিকের দুটি। ভেতরে কাঠ দিয়ে দেওয়াল বানানো। যেমনটি থাকে। ড্রাইভার বললো, বৃষ্টির ভয়ে লাগানো। তৃতীয় টা খুলবে কি খুলবে না ভেবে খোলা। ভেতরে তেমন কিছু নেই। নিরেট কাঠের দেওয়াল। তবু… কাঠগুলো ধরে একটু টানাটানি । কেন জানিনা মনে হচ্ছে, খুলে আসতেই পারে। যেন আলগা করে লাগানো।
একটুক্ষনের চেষ্টা।
খুলেই এলো। এই কাঠের পেছনেও আরো একটা দেওয়াল। কাঠেরই। সেটা মিলে যাচ্ছে ড্রাইভার কেবিনের ভেতরে যতখানি জায়গা, তার সঙ্গে।
আর এই কাঠের দেওয়াল আর সেই কাঠের দেয়ালের মাঝে সারি সারি করে সাজিয়ে রাখা, প্লাস্টিকের পেকেটে করে কিছু জিনিস।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ালো অমিত। টেস্ট না করেও সে জানে ওগুলো হচ্ছে, গাঁজার পেকেট। মেশিনে প্যাক করা, দশ কেজি অথবা পাঁচ কেজি ওজনের। গেলো দিনটা আজকের।
গাড়িটা থেকে এবার লাফিয়ে নামা। পেছনে কালকে থেকে অবহেলায় ফেলে রাখা এবং সেই ভাবেই পরখ করা সব বস্তা নামিয়ে নেওয়ার হুকুম দেওয়া। পেছনের ডালা নামিয়ে দেওয়া। যা ভেবেছে তাই। মেঝের ডালা গুলোর উপরেও সেই আলতো কাঠ জুড়ে রাখা। তার নিচে আসল মেঝে। আর দুই তক্তার সারির নীচে, থরে থরে বিছানো সেই প্লাস্টিকের প্যাকেট।
আবার ড্রাইভারের কেবিন। এবার ছাদ পরিদর্শন। নিচু ছাদের রহস্য একই। সেখানেও সেই প্লাস্টিকের প্যাকেট।
এবার আর শেষ দেখার জায়গা তেল রাখার ট্যাংক। আশ্চর্য্য। সেটাও দুটি টুকরোয় বানানো। অর্ধেকে সেই প্লাস্টিকের প্যাকেট।
এতক্ষন , এই উদ্ধার অভিযানে কেউ একটা কথাও বলেনি। চুপ চাপ , যেন কোন মুক সিনেমায় অভিনয় করছে সবাই।
আর কিছু নেই। তবু প্রত্যেক অফিসার , সিপাইরা ঘুরে ঘুরে দেখছে গাড়িটা।তারপর একসময় ভেতরে এসে বসা।
আজ অবধি এই ইউনিটে ধরা সবচেয়ে বড় নারকটিক্স এর কেস। ওজন না করেই বলা যায়। বোঝাই যাচ্ছে একটা খুব অর্গেনাইজড গ্যাং এর সঙ্গে জড়িত।
অর্থাৎ ,বেশ কিছুদিনের জন্যে জীবন হারাম । নেই, কারো মুখে হাসি নেই। সবাই গম্ভীর হয়ে বসা। এখনো শুধু মাত্র কিছু অফিসের লোক জানে। তার থেকে বেশি লোক যেন জানতে না পারে। কোন সংবাদ পত্রের কেউ যেন জানতে না পারে। খুব বেশি জানাজানি হয়ে গেলে সূত্র গুলো হারিয়ে যেতে পারে।
পল্লব দা শব্দ করে চায়ের কথা বললেন। একটু পরেই রুমে ঢুকলো অরুন, ইদু আর তপন। ড্রাইভার, আর বাকি দুজনকে, তুলে পাশের রুমে নিয়ে গেল। সঙ্গে ওই কালো রঙের ডান্ডা কাম রুলার। একটু পরেই ধুমধাম শব্দ। কান্নাকাটির। সঙ্গে উৎকট গালাগালি। তবু অন্য কেউ উঠলো না। ওই ঘরে গিয়ে কিছু বললো না। আসলে, একটু সফ্ট না করে রাখলে, পরে জবানবন্দি নিতে অসুবিধা।
শুধু একটা কালো রঙের ডান্ডা কাম রুলার বাঁচিয়ে রাখলো অমিত। কত মাল ধরা পড়েছে, তার হিসেব নিতে হবে। কোর্টে জানাতে হবে। সেই ছোটবেলা থেকেই, সাদা কাগজে, সোজাসুজি লিখতে পারে না। আর অফিসে, লেটার সাইজ বা লিগেল সাইজ যে সাইজের কাগজই কেনা হোক না কেন, সবসময় সাদা রঙের কেনা হয়।
(ক্রমশ )