(বারো বছর ধরে সম্পাদনা করছেন একটি অনবদ্য পত্রিকা “শুধু সুন্দরবন চর্চা”। সুন্দরবন বিষয়ক আলোচনায় যা শুধু উল্লেখযোগ্য নয়, অপরিহার্য৷ তাঁর তৈরি তথ্যচিত্র ‘ঘোড়ামারা: জীবন যে রকম’ একটি ভিন্নধর্মী কাজ হিসাবে সমাদৃত হয়েছে৷ ঘোড়ামারা দ্বীপকে নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বালিহাঁস-এর পাঠকদের শুনিয়েছেন জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী।)
মাঝে মাঝে যাই, কখনও পত্রিকার কাজে, কখনও বিনা কারণেই৷ প্রতিবার পৌঁছে মনে হয় এ কোথায় এলাম! আগে তো আসিনি এখানে! প্রতিবার নতুন নতুন জায়গায় এসে থামে কাকদ্বীপের লট এইট থেকে আসা ট্রলার৷ নামেই ট্রলার, আসলে একটু বড়সড় নৌকা৷ দিনে দু’থেকে তিনবার লট এইট থেকে ছাড়ে ঘোড়ামারা যাওয়ার নৌকা৷ ফিরেও আসে দুই বা তিনবার৷ কিন্তু এই আসা যাওয়ার সময় বদলায় প্রতিদিন৷ কারণ জোয়ার ভাটার সময়, কারণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কারণ লট এইটকে ঘিরে জেগে ওঠা বিশাল চর৷ ভাটায় সেখানে নৌকা চলার বদলে ছেলেরা ফুটবল খেলে বেড়ায়৷ শেষ যেদিন গেলাম এই গেল পূর্ণিমায়, সেদিন ঘোড়ামারা থেকে ফেরার নৌকা সাড়ে এগারোটার পর আবার সেই সাড়ে চারটেতে৷ তারপর আর কিছু নেই৷ আবার পরদিন সকালে৷
কাকদ্বীপ বা সাগরদ্বীপ থেকে ঘোড়ামারা দ্বীপকে দেখতে দূরবীন লাগে না৷ খালি চোখেই দেখা যায় দিব্যি৷ অনুকূল আবহাওয়ায় সময় লাগে মিনিট চল্লিশ৷ কিন্তু সুন্দরবনের আর পাঁচটা দ্বীপের সাথে ঘোড়ামারার তফাত আসমানের সঙ্গে জমিনের৷ এখানে প্রতিদিন তিল তিল করে কমে যাচ্ছে দ্বীপের আয়তন৷ হাজার চেষ্টাতেও সেই ক্ষয় ঠেকানো যাচ্ছে না৷ কমতে কমতে আজ ঘোড়ামারা দ্বীপের আয়তন মাত্র সাড়ে তিন বর্গ কিলোমিটার৷ পাশের দ্বীপ লোহাচরা আজ আর মানচিত্রে নেই, তলিয়ে গেছে বিপুল জলরাশির ধাক্কায়৷
এসব কথা নতুন কিছু নয়, যাঁরা একটু আধটু খবর রাখেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানেন এসব তথ্য৷ আন্তর্জাতিক স্তরের গবেষকদের কাছে ঘোড়ামারা এক অতি পরিচিত নাম৷ আজও প্রতিবছর বহু বিদেশী গবেষক-পর্যটক ঘোড়ামারাতে আসেন৷
বাম আমলে একবার সরকারি ভাবে ঘোড়ামারাকে জনবসতিহীন দ্বীপ বা “নো ম্যানস ল্যান্ড” হিসাবে ঘোষণা করা হয়৷ সরকার বদলের পর নীতির বদল হয় যথারীতি৷ আজও সরকারি হিসাবে ঘোড়ামারা দ্বীপে ১১২৫ টি পরিবারের বসতি৷ এঁদের অধিকাংশই অবশ্য বুঝেছেন আর যাই হোক, অদূর ভবিষ্যতে তাঁদের এ দ্বীপ ছাড়তে হবে৷ অনেকেই তাই ছোট হলেও কিছুটা জমি কিনে রেখেছেন দ্বীপের বাইরে৷ যাঁদের সে সামর্থ নেই, তাঁরা অপেক্ষায় আছেন সরকারি সাহায্যের৷ তিরিশটি পরিবারকে মাস কয়েক আগে সাগরদ্বীপে বসবাসের জন্য জমির পাট্টা দেওয়া হয়েছে।
ধ্বংসের মুখে থাকা এই ছোট্ট দ্বীপের একটি বিষয় আমাকে প্রথম থেকেই মুগ্ধ করেছে— তা হল, এখানকার মানুষের নিজেদের দ্বীপের প্রতি ভালবাসা৷ গত বছর বিধ্বংসী ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপটির নব্বই শতাংশ আধ ঘণ্টার মধ্যে চলে গিয়েছিল জলের নীচে৷ দ্বীপের চারদিকের দূর্বল নদীবাঁধ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল ভয়ঙ্কর ঝড়ের ধাক্কায়৷ সেই মহা বিপর্যয়ের কয়েক দিন পরও ঘোড়ামারার মানুষের মুখে শুনেছি— “এরকম দেশ তুমি কোথাও পাবে না”৷ নিজেদের ছোট্ট একখন্ড দ্বীপ যা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে ধ্বংসের দিকে তাকে নিয়েই তাদের “দেশ”৷ এর বাইরের পৃথিবীর হাজার সুখ স্বাচ্ছন্দের কথা জানা থাকলেও তাতে তাঁদের খুব বেশি আগ্রহ নেই৷ ১১২৫টি পরিবারের হাজার পাঁচেক মানুষ প্রত্যেকে প্রত্যেককে চেনেন৷ প্রত্যেকে খবর রাখেন প্রত্যেকের৷
হিন্দুদের প্রতিটি পূজায় যেমন সেখানে প্রত্যেক মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ অংশ নেন, তেমনি মুসলমানদের অনুষ্ঠানে হিন্দুরা ভাগ করে নেন আনন্দ৷ ভোটের আগের দিন পনের বাদ দিলে এখানে বাম-তৃণমূল-বিজেপি-কংগ্রেস চুটিয়ে আড্ডা দেয় চায়ের দোকানে৷ ভোট মিটে যাওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই রাজনৈতিক ভেদাভেদ মুছে যায় সহজেই৷
শুনে মনে হয়, এ এক স্বপ্ন রাজ্য৷ মনে হয়, এই হানাহানি, পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ির যুগে এমন সহাবস্থান অবিশ্বাস্য৷ যখনই যাই, একটি কথা শুনি— “আমাদের এখানে কোনও চোর নেই”৷ অবাক হই। ভাবি, ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা বা আগামীর চরম পরিনামের কথা ভেবেই কি মানুষের এই আশ্চর্য সহাবস্থান!
অথচ ঘোড়ামারা আজও আক্ষরিক অর্থে নেই রাজ্যের দেশ…দ্বীপের প্রধান ফসল পান-এর চাষ ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গত বছরের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে৷ পানের বরজ গুলির নব্বই শতাংশ আজও নতুন করে গড়ে তোলা যায়নি৷ সন্ধে নামতেই গোটা দ্বীপে নেমে আসে নিকষ অন্ধকার৷ হ্যাঁ, আজও ঘোড়ামারা দ্বীপে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই৷ অবস্থাপন্নদের ঘরে চলা জেনারেটর বা সোলার আর সাধারণ মানুষের কেরোসিনই ভরসা৷ চারটি প্রাথমিক ও একটি মাধ্যমিক স্কুল থাকলেও শিক্ষকের অভাবে সেগুলি মৃতপ্রায়৷
আর এসবের পর ঘোড়ামারা-র সবচেয়ে বড় সমস্যা এর অস্তিত্বের সংকট৷ “আজ আছে কাল নেই”— এ কথা ঘোড়ামারা-র প্রতিদিনের৷ আজ যে নারকেল বা খেজুর গাছের নীচে নৌকা এসে ভিড়ছে, পরের বার এসে সে গাছ আর খুঁজে পাই না৷ একটু একটু করে দ্বীপের মাটি মিশে যাচ্ছে নদীর জলে৷ ভাদ্রের ভরা বর্ষায় প্রবল হাওয়ায় ঘোড়ামারা দ্বীপে দাঁড়িয়ে মনে হয় এক চলমান ভূমিখণ্ডের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি৷ গ্রামে তিনপুরুষের বাস যাঁদের তাঁদের অধিকাংশই সাত আটবার বসতবাড়ির স্থান পরিবর্তন করেছেন৷
তবু যেটুকু আছে, সেটা নিয়েই থেকে যেতে চান তাঁরা৷ গ্রামের প্রবীণ শোনান ঘোড়ামারা দ্বীপের উর্বর মাটির কথা, “হাত থেকে একটা বীজ যেখানে পড়বে, সেখানেই গাছ হবে আমাদের দ্বীপে, এত জান (শক্তি) এই মাটির”৷ মাছেরও অভাব নেই দ্বীপের আশপাশে৷ প্রকৃতপক্ষে তিন বা চার পুরুষ আগে মেদিনীপুর থেকে নদী পেরিয়ে মাছ ধরার জন্যই তো আসা এ দ্বীপের চারপাশে৷
ঘোড়ামারার মূল সমস্যা নিঃসন্দেহে ভাঙন৷ দ্বীপের দ্রুত ছোট হয়ে আসার কারণ হিসাবে বিশেষজ্ঞ থেকে সাধারণ মানুষ সকলের মুখে শোনা যায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের জলের উচ্চতা বৃদ্ধির কথা। পাশাপাশি শোনা যায়, হলদিয়া বন্দরকে বাঁচাতে সমুদ্রের মাঝে দেওয়া গার্ড ওয়ালের কথা৷ দ্বীপের দক্ষিণপ্রান্ত বরাবর যাতায়াত করা ফ্ল্যাইঅ্যাশ বহনকারী বিশালাকৃতি জাহাজগুলির তৈরি করা ঢেউয়ের ধাক্কাও যে দূর্বল দ্বীপের ওপর “মরার ওপর খাঁড়ার ঘা” সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷
গত বছর জুলাই মাসে ঘোড়ামারাকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণের সময় একটি নৌকায় দ্বীপটির চারদিক প্রদক্ষিণের পরিকল্পনা করেছিলাম৷ মাঝি যা চাইছেন— তা দিতে চাওয়ার পরও কেমন যেন রাজি হচ্ছিলেন না যেতে৷ কারণটা বুঝলাম দ্বীপের পশ্চিম দিকে যাওয়ার পর, উথাল পাথাল সেই ঢেউয়ের ধাক্কা সামলাতে হিমসিম খাচ্ছিলেন মাঝি। আমরা বুঝতে পারছিলাম এই বিপুল ঢেউয়ের ধাক্কার কাছে কত অসহায় ঘোড়ামারা৷ সেই সময় দ্বীপের প্রায় সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকা খাসিমারা প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে দেখেছিলাম৷ মাস কয়েক পর ফেসবুকে সে স্কুল বাড়ি ভেঙে পড়ার চলমান দৃশ্য দেখলাম৷ আজ সেই ভেঙে যাওয়া স্কুলের আনাচে কানাচে ঘুরতে ঘুরতে চিনতেই পারছিলাম না জায়গাটাকে৷ আসলে সত্যিই এখানে প্রতিদিন পাল্টে যায় ভূগোল৷
ঘোড়ামারা গ্রাম পঞ্চায়েত এত হতাশার মাঝেও হাল ছেড়ে বসে নেই৷ পরাজয় নিশ্চিত জেনেও তাঁরা নিচ্ছেন নানা পরিকল্পনা৷ সরকারি প্রকল্পগুলি গ্রামের পঁচানব্বই শতাংশ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে৷ সেদিন একটি অনুষ্ঠানে শুনলাম, দ্বীপের মানুষ সমবেত ভাবে চাইছেন, তাঁদের দ্বীপে প্লাস্টিক ও থার্মোকল ব্যবহার নিষিদ্ধ হোক৷ চাইছেন পর্যটকরা আসুন ঘোড়ামারা দ্বীপে৷
কাকদ্বীপের লট এইটকে ঘিরে গড়ে ওঠা বিশাল চরভূমি নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে ঘোড়ামারাকে৷ “আমাদের দ্বীপ ঘিরে যদি এমন চর জাগে তবে আমরাও ফিরে পাব বাসস্থান” সাধারণ মানুষের এ ধরনের কল্প বাক্য শুনে ডিগ্রিধারী মহাপণ্ডিতেরা করুণার হাসি হাসলেও ভাঙাগড়ার এই সুন্দরবনে আগামীদিনের কথা বলতে পারেন একমাত্র প্রকৃতিদেবীই৷ আর এই এত বছর পরও তাঁর প্রকৃত রহস্য আজও মানুষের অধরা৷
অসাধারণ লেখায় প্রকৃতির রোষের কোপে হারিয়ে চলা দ্বীপবাসী সাধারণ মানুষের কথা মর্মস্পর্শী। এই প্রকৃতির রোষও তো প্রকারান্তরে বিশ্বজোড়া লোভী মানুষের সভ্যতার আগ্রাসী হাত
ধন্যবাদ আপনাকে
ঘোড়ামারাতে বার চারেক গিয়েছি বিভিন্ন সময়ে। আপনার আলোচনার সঙ্গে সব বিষয়ে সহমত। পনের দিনের মধ্যে দু’বার যাওয়ার অভিজ্ঞতায় দেখেছি দ্বীপভূমি থেকে বেশ কয়েক ফুট ভূমিভাগ কমে যেতে। দ্বীপের প্রত্যেকটা গ্রাম ঘুরেছি। খুব কম সময়ে প্রতিটি গ্রাম ঘোরা যায়। মানুষেরা সদালাপী, বেশ মানবিক। সমুদ্র থেকে নদীতে যখন জোয়ারের জল ঢোকে জলের টানে/ধাক্কায় দ্বীপভূমিতে যে মৃদু কম্পন হয় অনুভব করা যায় লঞ্চঘাটের কাছে নদীর পাশে দাঁড়ালে। চারিদিকের বিশাল জলরাশির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিদিন ক্ষয়ে যাওয়া এই দ্বীপভূমির মধ্যে দাঁড়ালে আতঙ্কের শিহরণ জাগে। জ্যোতিদা আপনি যথার্থই বলেছেন প্রকৃতিই জানে ঘোটামারার ভবিষ্যৎ ভূগোলের ইতিহাস।
ধন্যবাদ আপনাকে।
[…] […]