পর্ব -১৪
আইপিএস সুখেন্দুহীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারীপাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে স্মৃতির যুগ পর্যন্ত নারী স্বাধীনতা ক্রমে ক্রমে খর্ব হয়েছে। মধ্যযুগে এসে তা একেবারে গৃহে অন্তরীণ হয়ে পড়ল। এটা অবশ্য একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে হয়েছে। আবার বিংশ শতাব্দী থেকে ভারত তথা বাংলার নারীদের গৃহের বাইরে কর্মজগত আস্তে আস্তে খুলতে শুরু করে। আজ কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবুও কিন্তু আজো মেয়েরা সর্বত্র স্বাগত নয়। একটা চিরাচরিত দ্বিধা কাজ করে চলেছে।
অনেকে বলেন, ‘সব পেশাতে সমাজ সহজে মেয়েদের মেনে নেয় না’ তা কিন্তু নয়; মেয়েরাও সাহস করে ঝুঁকিবহুল পেশায় যেতে চায় না। আজও সমাজে এবং মেয়েদের কাছে ভদ্র ও নির্ঝঞ্ঝাট পেশা হল শিক্ষকতা। অথবা নার্স বা সেবিকা। শ্বশুরবাড়িতে চাকরী করা মেয়েদের আদর হয় না; এজন্য অনেক সময় বিবাহের পর চাকরী ছেড়ে দিতে হয়। এই অবস্থার দিন দিন উন্নতি হচ্ছে, তবুও একটা ধন্ধ থেকে যাচ্ছে সকলের মনে।
কর্মরত মেয়েদের দ্বৈত চরিত্র পালন করতে হয়। বাড়িতে বধু, স্ত্রী ও মায়ের ভূমিকা। অফিসে সহকর্মীর ভূমিকা। পুরুষ সহকর্মীদের এতোটা আপোষ করতে হয়না বা প্রথম গুলিকে সহজে উপেক্ষা করতে পারেন। পুরুষ কখনো মনে করেনি যে জীবনে তার পুত্র, পতি, পিতা হওয়াতেই সার্থকতা। বরং এ ভূমিকাগুলো এড়িয়ে যাওয়াকেই মনে করেছে পৌরুষ। নারী যতই উচ্চপদস্থ চাকুরীজীবী বা নিজ ক্ষেত্রে লব্ধপ্রতিষ্ঠ হোন না কেন তিনি সংসার ও সন্তানকে এড়াতে পারে না। এই দ্বৈত সত্তা সামলানোর চেয়ে ‘হাউসওয়াইফ’ হওয়া অনেক শান্তির, বহু নারীর কাছে। তাই পেশাদারী জগৎ উন্মুক্ত হলেও সব নারীকে আকর্ষণ করেনি। তাছাড়া কর্মক্ষেত্রে নানা ভাবে হেনস্থা তো রয়েছেই। সাধারণ মেয়ে হিসাবে রাস্তাঘাটে, পাড়ার গলিতে যে হেনস্থা তাকে সইতে হয়, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ তার চেয়ে বেশি কিছু ভালো থাকে না। সরকারি চাকরীর ক্ষেত্রে পোস্টিং, বেসরকারী চাকরীর ক্ষেত্রে প্রমোশন ইত্যাদির প্রলোভন থাকে। তাই অনেকে মুখ বুজে মেনে নেয় অন্যায় আবদার। প্রতিবাদ করলে একা হয়ে যেতে হয়। প্রতিবাদ হিসেবে সুপ্রিমকোর্টের ‘বিশাখা গাইডলাইন’ আছে। প্রতি অফিসে ইনকোয়ারি কমিটি আছে। কিন্তু অভিযোগ জানালে, সেই অভিযোগ প্রমাণ করার ব্যাপার আছে। এই সব কারণে কর্মক্ষেত্রে মেয়েরা দুদিক সামলে একটা মধ্যমপন্থা নিয়ে চলে। এর জন্য তাদের মূল্য কম দিতে হয় না। এই জটিলতার কারণে মেয়েরা ঘরের বাইরের কর্মজগৎকে খুব দায়ে না পড়লে আপন করতে চায় না। অনেকে বলবেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পাচ্ছে, ঘরের বাইরে যেতে পারছে। এগুলিও কিন্তু একপ্রকার দায়।
ঘরের কাজ বা পারিবারিক ব্যবসা বাদ দিয়ে ঘরের বাইরে মেয়েদের প্রথম পেশা ছিল দাসীবৃত্তি। তা ক্রীতদাসী হিসাবেই হোক বা লোকের বাড়িতে গৃহকর্ম করেই হোক। এই পেশা যতো পুরোনোই হোক না কেন আজও এই পেশা সুসংঘবদ্ধ নয়। সুসংঘবদ্ধ না হলে শোষণের সুযোগ থেকে যায়। শুধু পরিচারিকার কাজ নয় অন্যান্য অনেক পেশাই আজও সুসংঘবদ্ধ নয়; এমনকি গণিকাবৃত্তিও।
অনেকে বলে পৃথিবীর আদিমতম পেশা হল মেয়েদের দেহ ব্যবসা। তবে গণিকাবৃত্তি প্রথমে ব্যবসা ছিল না। গণিকাবৃত্তি শুরু হয়েছিল প্রায়শ্চিত্তমূলক দেহদান হিসাবে। পূর্বে নারীরা দেবীর মন্দিরে অর্থের বিনিময়ে আত্মদান করে প্রায়শ্চিত্ত করতেন সতীত্বের। অর্থ জমতো মন্দিরের ভান্ডারে। আর্মেনিয়ার আনাইটিসের মন্দির ও করিন্থের আফ্রোদিতির মন্দিরের পরিচারিকারা ও ভারতের মন্দিরের দেবদাসীরা ছিলেন প্রথম গণিকা।
সম্পদের বৈষম্য সৃষ্টি করল ক্রীতদাস প্রথা। এরপরে ক্রীতদাসীরা বাধ্য হল মনিবকে দেহ দান করতে। তারপর শুরু হয় স্বাধীন নারীদের পতিতাবৃত্তি। আধুনিক যুগে মেয়েরা স্বাধীনভাবে পতিতাবৃত্তি বেছে নেয় খুব অল্প জনই। এখনও বলা যায়, দায়ে না পড়লে স্বেচ্ছায় এ পেশায় কেউ আসে না। হেমেন্দ্র কুমার রায় তাঁর ‘কলকাতার রাত্রি রহস্য’ (১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ) বইটিতে লিখেছেন, “আমি শপথ করে বলতে পারি, সর্বোচ্চ স্তরের সর্বপ্রধান গণিকাও সুখী নয় এবং তার আত্মদানেও উপভোগ নেই। তার মুখে হাসি দেখেছেন? হ্যাঁ হাসি বটে! কিন্তু ও হাসির চেয়ে কান্নাও ভালো। হাসি যে এখানে দুঃখের ঘোমটা’’।
মহিলারা যখন থেকে বাইরে কাজ করতে বেরোলো, তখন থেকে নানা ফাঁদ পাতল নারীপাচার কারীরা। কাজের টোপ দিয়ে নারী পাচার অতি সহজ এক পন্থা। কিন্তু ভারতবর্ষের এই আর্থসামাজিক পরিবেশে মেয়েদের বাইরে বেরোতে হয়েছে, আর সহজেই পাচার হয়েছে। বেতনের লোভ দেখিয়ে নারী ও শিশুদের বড় বড় শহরে নিয়ে যাচ্ছে পাচারকারীরা। পাচার হওয়া দুই-তৃতীয়াংশ শিশুই বালিকা। দেহব্যবসাতে নামলেই শুধু পাচার নয়। আটকে রেখে কম বেতনে কাজ করিয়ে নেওয়াও একপ্রকার পাচার।
নারীদের জন্য যথেষ্ট সুসংঘবদ্ধ কর্মক্ষেত্র না থাকায় নারীরা সহজেই পাচার হচ্ছে।
তথ্য-ঋণ:
১. নারী – হুমায়ুন আজাদ (আগামী প্রকাশনী, বাংলাদেশ)।
২. আনন্দবাজার পত্রিকা (০২.০৬.২০২২)