পর্ব-২৩

(আইপিএস সুখেন্দু হীরা বর্তমানে কলকাতা পুলিশের ডেপুটি কমিশনার (DCP)। নারী পাচার নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখছেন বালিহাঁস-এর পাতায়।)

তৈত্তিরীয় উপনিষদে আছে “অতিথি দেব ভবঃ”। অর্থাৎ অতিথির মধ্যে দেবতার স্থিতি। সেখানে অবশ্য শুধু অতিথির কথা বলা নেই, বলা হয়েছে- মাতৃদেব ভবঃ, পিতৃদেব ভবঃ, আচার্য দেব ভবঃ ও অতিথি দেব ভবঃ। পুরাণেও অতিথি দেবতার মতো সমাদর পেতেন তার বহু নিদর্শন আছে। আজও বাংলায় ঘরে ঘরে বলা হয়, ‘অতিথি নারায়ণ’। তাকে যত্ন ও আহার দিয়ে সেবা করতে হয়। অতীতে অতিথির সন্তোষের জন্য গৃহকর্তা নিজের স্ত্রী বা কন্যাকে অতিথির কাছে সেবাকার্য করার জন্য পাঠাতেন। সে যুগে হয়তো এটাকে খুব খারাপ চোখে দেখা হতো না। এই যৌন অতিথেয়তার উদাহরণ মহাভারতেও আছে। সেখানে এই অতিথেয়তার প্রশংসা করা হলেও সামান্য দ্বিধা ছিল বলে মনে হয়।

          মহাভারতের অনুশাসন পর্বে আছে, অগ্নিপুত্র সুদর্শনের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল নৃগরাজ কন্যা ওঘবতীর। তারা দুজনে কুরুক্ষেত্রে বাস করতেন। সুদর্শন ওঘবতীকে বলেছিলেন, “তুমি অতিথিকে সর্ব প্রকারে তুষ্ট রাখবে, এমন কী প্রয়োজন হলে নির্বিচারে নিজেকেও দান করবে।”

         একদিন সুদর্শন কাষ্ঠ সংগ্রহ করতে গেলে স্বয়ং ধর্ম ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে অতিথি হয়ে সুদর্শনের গৃহে হাজির হন এবং ওঘবতীকে কামনা করেন। ওঘবতী পতি আজ্ঞা স্মরণ করে রাজী হয়ে যান। ততক্ষণে সুদর্শন জঙ্গল থেকে ফিরে আসেন। আতিথেয়তায় খুশি হয়ে ধর্ম স্বমূর্তি ধারণ করে বর দিলেন- সুদর্শন সশরীরে ও ওঘবতী অর্ধ শরীরে স্বর্গ লাভ করবে এবং ওঘবতীর অর্ধ শরীর ওঘবতী নদী হয়ে লোকপাবন করবে।

         এইভাবে শাস্ত্রে বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্ককে বৈধতা দিয়েছে। তবে সব বিবাহ-বহির্ভূত যৌন-মিলনকে শাস্ত্র অনুমোদন দেয়নি। অনেক অবৈধ যৌনসংসর্গকে ব্যভিচার বলা হয়েছে। সর্বাপেক্ষা জঘন্য ব্যভিচার বলা হয়েছে গুরুতল্পকে অর্থাৎ গুরু-স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সংসর্গকে। স্মৃতিশাস্ত্রে বিভিন্ন ব্যভিচারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির ব্যবস্থা ছিল। আবার স্মৃতিশাস্ত্রে বিধান অনুযায়ী বিনাদণ্ডে কোনও কোনও নারীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করা যেতো। এই নারীদের মধ্যে ছিল গণিকা ও ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য বর্ণের স্বৈরিণী। এমনকি, এ-ও বলা হয়েছে— স্বামী-পরিত্যক্তা, নিষ্কলঙ্কা স্ত্রীলোকের সঙ্গে যৌনমিলন ব্যভিচার বলে গণ্য হবে না। নারীদের দু’টিমাত্র ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে ছাড় দিয়েছে। স্বামী যদি নপুংসক হয় বা ক্ষয়-রোগাক্রান্ত হয় তাহলে অপর পুরুষের সঙ্গে যৌনসঙ্গম ব্যভিচার বলে গণ্য হবে না। 

           তন্ত্রশাস্ত্রে ধর্মানুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌন মিলনের অনুমোদন আছে। তন্ত্রসাধনার মূল কথা হচ্ছে প্রকৃতি ও পুরুষের মিলন। নারী হল প্রকৃতির রূপ। তন্ত্রশাস্ত্রে ‘পঞ্চতত্ত্ব’ নির্বাণ লাভের পথ। পঞ্চতত্ত্ব পঞ্চ ‘ম’-কার নামেও পরিচিত। পঞ্চমকার হল- মদ্য, মাংস, মৎস, মুদ্রা ও মৈথুন। গুপ্ত সংহিতায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি শক্তিসাধনার সময় কোনও স্ত্রীলোকের সঙ্গে মৈথুন ক্রিয়ায় নিজেকে নিযুক্ত রাখে না, সে পামর। নিরুক্ততন্ত্র ও অন্যান্য তন্ত্রে বলা হয়েছে বিবাহিত নারীর সহিত যৌন মিলনে প্রবৃত্ত না হলে কোনওরূপ পূণ্যফল পাওয়া যায় না। শক্তি সাধনার অপর নাম কুলপূজা। কুলপূজার জন্য কোনও নারী যদি সাময়িক ভাবে স্বামী পরিহার করে, তবে তার কোনও পাপ হয় না। কুলপূজার জন্য প্রশস্তা নারী হচ্ছে ষোড়শী, সুদর্শনা এবং বিপরীত রমণে সিদ্ধা। তবে অনূঢ়া কিংবা গণিকাকেও কুলপূজার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে।

       পঞ্চতত্ত্ব যুক্ত সাধনার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হল চক্রানুষ্ঠান। চক্রপূজায় পাঁচ শ্রেণীর গণিকাকে শক্তি বা দেবীর স্থান দেওয়া হয়েছে। এই পাঁচ শ্রেণীর গণিকা হল- রাজবেশ্যা, নাগরী, গুপ্তবেশ্যা, দেববেশ্যা ও ব্রহ্মবেশ্যা বা তীর্থগ। রাজবেশ্যা বলতে বোঝাতো রাজার দ্বারা অনুগৃহীত গণিকা, নাগরী বলতে বোঝাতো নগরবাসিনী গণিকা, গুপ্তবেশ্যা বলতে বোঝাতো সদ্বংশীয়া নারী যে গোপনে অভিসার করে, দেববেশ্যা বলতে মন্দিরের দেবদাসীদের বোঝাতো এবং ব্রহ্মবেশ্যা বা তীর্থগ বলতে বোঝাতো তীর্থস্থানে যারা গণিকাবৃত্তি করতো, তাদের।

         ধর্মের নামে যে গণিকাবৃত্তি মন্দিরে মন্দিরে প্রচলিত ছিল; তা দেবদাসী প্রথা নামে প্রচলিত ছিল। এ সম্পর্কে আগেও বলা হয়েছে। শুধু হিন্দুমন্দিরে নয়, বৌদ্ধমন্দিরেও দেবদাসী থাকতো। দেবদাসী প্রথা কত প্রাচীন, তা সঠিক ভাবে বলা মুশকীল। ভারতবর্ষে সবচেয়ে প্রাচীন যে প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা হল- কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’-এ। কৌটিল্যের সময়কাল ধরা হয় খ্রি.পূ. ৩৫০-২৮৩ সাল। মধ্যযুগে বাংলাদেশের বড় বড় মন্দিরে দেবদাসী থাকতো। ভবদেব ভট্টের ‘ভূবনেশ্বরী প্রশস্তি’, বিজয় সেনের ‘দেওপাড়া প্রশস্তি’তে  এর উল্লেখ পাই। সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’, ধোয়ীর ‘পবনদূত’ কাব্যে দেবদাসীর কথা উল্লেখ আছে।

         ধর্মের নামে আমাদের দেশে গণিকাবৃত্তি চালিয়ে গেছে সমাজ। ধর্মশাস্ত্র রচয়িতাগণ এই প্রথার মুক্ত কণ্ঠে প্রশংসা করেছেন। গণিকা হয়ে তো কেউ আর জন্মগ্রহণ করে না। সমাজ কিছু অসহায় নারীকে এই বৃত্তিতে ঠেলে দেয়। সমাজ এই প্রথাকে মহিমান্বিত করে চালু রেখেছে এবং এর জন্য সাহায্য নিয়েছে বিভিন্ন শাস্ত্রের। তাই নারীপাচার যুগ যুগ ধরে টিঁকে থাকার জন্য শাস্ত্রগ্রন্থগুলির ভূমিকা কম নয়।

তথ্য ঋণ-

১. মহাভারত: সারানুবাদ – রাজশেখর বসু।

২. কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র: সংক্ষিপ্ত অনুবাদ – সুকুমার শিকদার (অনুষ্টুপ)

৩. ভারতের বিবাহের ইতিহাস – অতুল সুর (আনন্দ পাবলিশার্স)।

৪. শাস্ত্রমূলক ভারতীয় শক্তিসাধনা- দ্বিতীয় খন্ড- উপেন্দ্রকুমার দাস- রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার।