পর্ব -২৭

(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)

বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেছে আমরা ওই ছোট খালটার ভিতরে ঢুকেছি। আমি, পলিন আর রাজীব প্রায় গুটিশুটি মেরে আছি।  তীব্র শীত, তার উপর চারদিকে গাছপালা। আর জামাকাপড় ভিজে! একেবারে ঠকঠক করে কাঁপছি। আর অপেক্ষা করছি কখন আসবে বেলায়েত সরদারের ট্রলার।

দেখলাম ট্রলারের চুলায় রান্না বসে গেছে। রান্না বলতে ভাত আর ডাল। মনে হল, ক্ষুধাও তো পেয়েছে!  কিন্তু  যা পরিস্থিতি তাতে আপাতত চুপটি মেরে চুলার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নাই। ওতেই যদি জামাকাপড়গুলি শোকানো যায়। আমি ঠান্ডায় এতটাই কাবু হয়ে পড়েছিলাম যে খেয়াল ছিল না  চুলার একেবারে কাছে চলে এসেছি। হঠাৎ আমার প্যান্টে আগুন ধরে গেল। সেই আগুন নেভাতে গিয়ে আর এক কাণ্ড। যাই হোক, বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটেনি। এবার চুল্লি থেকে সরে আবার কেবিনে চলে এলাম।  সময় কাটছে না।  দুপুর গড়িয়ে গেলো , বিকেলও শেষ। কেটে যাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। চুপচাপ শুয়ে  আছি। সন্ধে নেমেছে। হঠাৎ শুনি গানের শব্দ।  মুখ বাড়িয়ে দেখি, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে মাস্টার-সহ বেশ কয়েকজন আসছে। গান গাইছে বাচ্চু। ওদের দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।  কিন্তু বেলায়েত সরদার কই? ও তো নেই ওদের সাথে ! দৌড়ে গেলাম মাস্টারের কাছে। উৎকন্ঠা আমার মধ্যে। -বেলায়েত কোথায়? আমার লোকজন কোথায় ?

 —অসুবিধা নাই ভাই।  আমি সবার আগে গিয়ে  বেলায়েত সরদারকে খুঁজে বার করি। তারপর ওর ট্রলারটার যতটুকু সারাইয়ের কাজ ছিল, সেটা কমপ্লিট করি। আমাদের আসার পথে সামনে যে খালটা আছে, ওখানেই বেলায়তের ট্রলারটি রেখেছি। আর একটু রাত হলে আমার লোক গিয়ে আপনার বেলায়েতকে নিয়ে আসবে। তার ট্রলারটাও চালিয়ে নিয়ে আসবে। বাকি সবাই ঠিক আছে। আমাকে আশ্বস্ত করল মাস্টার। নিশ্চিন্ত হলাম আমি।

সত্যি, একটু পরে একজন লোক জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে বেলায়তের ট্রলারটি নিয়ে আসলো আমাদের ট্রলারের কাছে। বেলায়েত ঠিক আছে, তার ট্রলারও  চলে এসেছে। আমার মনের উৎকন্ঠা কেটে গেছে। ঠিক এই সময় মনে পড়লো ভীষণ শীত করছে তো।  যাই, ট্রলারের থেকে জামাকাপড়গুলি বদলে নেই।  ট্রলারে গেলাম। আমার লাগেজ খুঁজছি।  কিন্তু কোথায় জামাকাপড় ? -বললাম, বেলায়েত ভাই, লাগেজ কই আমার!

-লাগেজ ! লাগেজ দিয়ে কি করবেন? -বেলায়েত পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো।

-কেন! লাগেজের কি হয়েছে? নিয়ে গেছে কেউ!

-না, কেউ নেয়নি। তবে লাগেজ খুঁজে কোনও লাভ হবে না— এই বলে বেলায়েত মিটমিট করে হাসছিলো।

– কি হইসে !

-ওই আপনার জামাকাপড় সব দিয়ে দিছি ভাই।

-(বলে কি!) কাকে দিয়েছেন ?

-ওই জেলে ছিল, ডাকাত ছিল মিলায়ে ঝুলায়ে দিসি। এমন ভাবে বলল, আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ করে হাসি বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে।

-ভাল করসেন।

আসলে বিষয়টা হল, যারাই তখন দৌড়াচ্ছিল সবারই জামাকাপড় ছিঁড়ে গেছে, ভিজে গেছে। সেগুলি আর পরার অবস্থায় নেই। তা দেখে বেলায়েতের খুব মায়া হয়। ও তখন ওর ট্রলারে যত জামাকাপড় ছিল— ওর, আমার, সবার লাগেজ খুলে জামাকাপড়গুলি জেলে বা ডাকাত কোনও বিচার না করে সবার মধ্যে ভাগ করে দিয়েছে। ওর এই কাণ্ড শুনে আমরা যারাই ওখানে ছিলাম খুব হাসলাম। সারাদিনের যত ধকল , টেনশন সবটাই যেন নিমেষে মিলিয়ে গেল।

বেলায়েত আবার আমাকে ঘুষ দেবার চেষ্টা করলো।

—চিন্তা নাই ভাই, যাবার সময় আপনাকে দুধ চা খাওয়াতে খাওয়াতে নিয়ে যাবো।

এদিকে রাত বাড়ছে। কিন্তু সেদিন দস্যুদের কাজ কমেনি। এই সময় ওরা একটা একটা করে সমস্ত ট্রলারগুলো নিয়ে এলো আমরা যেখানে ছিলাম সেখানে। মোটামুটি  সব দস্যু আর অপহৃত জেলে চলে এসেছে। একজন দস্যু বাদে।  ওর নাম হল গালকাটা রবিউল, ওকে দেখলাম না। ওর গালে একটা বড়ো কাটার দাগ ছিল তাই ওর নাম গালকাটা রবিউল। কোস্টগার্ড বাহিনীর আক্রমণের সময় কিছু অপহৃত জেলেকে নিয়ে রবিউল এক সাইডে চলে যায়।

যাই হোক এইবার আমাদের ফিরে আসার পালা। কিন্তু এবারের পথ তো আমরা চিনি না। এই খালের ভিতর দিয়ে আমাদের ফিরতে হবে। রাতে ফিরবো কি করে ?  তখন রাত এগারোটা, সাড়ে এগারোটা বাজে। আমরা খাওয়াদাওয়া করে নিলাম। এদিকে সোহাগ ভাই একটা সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে ,সেই কাগজ আর কলম নিয়ে বসে গেল আমাকে ম্যাপ বোঝাতে। ওনার আবার ডান হাতটা নষ্ট। গুলি লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। লেখার সময় হাত খুব কাঁপে। লেখাগুলি আঁকাবাঁকা হয়ে যায়। ম্যাপটাও হল তেমনই।  তবুও তিনি আমাকে বোঝাচ্ছিলেন ঠিক কোন পথে আমাদের যেতে হবে। সত্যি বলতে কি, ম্যাপ নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখাইনি। গুগল জিপিএস আছে। গুগল ম্যাপ দেখে  ঠিক বেরিয়ে যাবো। এই ভেবে আমি মনোযোগ দিলাম না। আর সেটাই কাল হল আমাদের। সোহাগ ভাই ম্যাপটা আমাকে দিল আর আমি হেলা ভরে সেই কাগজ পকেটে রেখে দিলাম।

রওনা দিলাম মাস্টারের ডেরা থেকে। ফিরবো মংলায়, সেখান থেকে ঢাকা। বিদায় নিলাম সবার থেকে। মাস্টারকে প্রতিশ্রুতি দিলাম, যথাসাধ্য আমি করবো। ফেরার সময় মাস্টার জড়িয়ে ধরলো আমাকে। ট্রলার ভাসালো বেলায়েত। একটু দূরে গিয়ে আমি মোবাইল অন করলাম। কিন্তু গুগল ম্যাপ আসছে না।  কি হলো ? মনে পড়লো, মোবাইলের পুরনো ফাইল ক্লিয়ার করে দিয়েছি। এখানে নেটওয়ার্কের যা অবস্থা ডাউনলোড করাও সম্ভব নয়। যাবো কি করে? ওদিকে আমাদের ছেড়ে দিয়ে অন্য পথ ধরেছে মাস্টারের ট্রলার বহর। আর কথা বলার সুযোগ নাই। কী করি?

মনে পড়লো সোহাগের ম্যাপের কথা। পকেটে তো খুঁজে পাচ্ছি না। আর সেই ভাবে মন দিয়ে ওর কথা শুনিনি। এই ঘন অন্ধকারে পথ হারাতে হবে নাকি ? আবার কি দুর্দশায় পড়লাম আমরা!

(ক্রমশ)

1 COMMENT

Comments are closed.