পর্ব ৪৫

(মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।  তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।)

ওই একই বছর এভাবে একে একে সাগর বাহিনী ও খোকাবাবু বাহিনী-সহ মোট পাঁচটি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে ফেলল।  এই দুটি বাহিনীর সদস্য সংখ্যা যথাক্রমে ১৩ ও ১২।  সব মিলিয়ে পাঁচ বাহিনীর ৬০ জন দস্যু আত্মসমর্পণ করে।  উদ্ধার হয় ১৩৯টি অস্ত্র ও ৭৫৩১টি গোলাবারুদ।

পর পর এতগুলি দস্যু বাহিনী আত্মসমর্পণ করার পরেও আরও অনেকগুলি— প্রায় দেড় ডজন দস্যু বাহিনী তখন সুন্দরবন জুড়ে ডাকাতি করছিল। তাদের এই অপকর্ম আমার শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠছিল।

পুরো বিষয়টি খুলে বলা যাক।

আগের পর্বগুলিতে বলেছি, সুন্দরবনের জলদস্যু শুধু জলের দস্যুতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এই ডালপালা বহু বিস্তৃত। বলা যায় , কিছু লোক এই জলদস্যুতাকে একটি ইন্ডাস্ট্রির পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। কালো টাকা, অবৈধ অস্ত্র , কিডন্যাপিং, ক্ষমতার অপব্যবহার— সব মিলিয়ে সমাজের প্রতিটি স্তরে এর বিস্তার। তাই স্বার্থে আঘাত লেগেছিল অনেকের। দস্যুদের আত্মসমর্পণের ঘটনায় কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপ ও তাদের নেতারা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কারণ, দস্যুদের সামনে রেখে সুন্দরবনে ও সাগরে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছিল এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি।

ব্যবসায় মন্দা দেখা দিল তাদের। উঠেপড়ে লাগলেন তারা। বিভিন্ন মাধ্যমে নানা অপপ্রচার শুরু করলেন তারা। জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলেন এই বলে যে, আত্মসমর্পণের যা কিছু ঘটনা ঘটছে— সবটাই নাটক। এতে কোনও কাজ হবে না। দুবলার চরের বড় মহাজন বলতেন আত্মসমর্পণের নাটক সাজিয়ে ব্যবসা করছে RAB।

আসলে যারা এই অপপ্রচার করছিলেন, তারাই হলেন দস্যুদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক।  দস্যুদেরকে অস্ত্র ও গুলির জোগানও এদের মাধ্যমেই হতো। তারা নিজেদের দসুদলগুলির মালিক মনে করতেন। জলদস্যুদের দলগুলিকে সুন্দরবনের নদী ও সাগরে নিজেদের মাছ ধরার ও এলাকা দখলে রাখার জন্য ব্যবহার করতেন।

ফলে দস্যুদের পর পর আত্মসমর্পণের ঘটনায় এরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন।

কিন্তু  আমি ভেবে নিয়েছিলাম, যে পথে এগিয়েছি, তার থেকে ফেরার কোনও প্রশ্নই নেই। ২৫মে, ২০০৯। আইলা আঘাত করেছিল বাংলাদেশে। আমি তার পরের দিন এসেছিলাম এখানে। দেখেছি সুন্দরবনের মানুষ অন্য কোনও ব্যাপারে ভয় পান না। ভয় পান শুধু জলদস্যুদের।৩০ লাখ মানুষ এই জলদস্যু বাহিনীর অত্যাচারে স্বাভাবিক ছন্দে জীবন যাপন করতে পারেন না। 

কিন্তু যত দিন গেছে— যত আমি এই জলদস্যুদের সঙ্গে মিশেছি— তত বুঝেছি ,এরাও কোথাও যেন অসহায়। একটা সুযোগ পেলে এরাও চায় এই পেশাকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু অল্প সংখ্যক মানুষ চান না সুন্দরবনের দস্যুরা ডাকাতি ছেড়ে দিক। সবটাই তাদের স্বার্থে। তাই এদের হাত থেকে সুন্দরবনের মানুষকে বাঁচাতে, সুন্দরবনকে বাঁচাতে, সর্বোপরি এই দস্যুদেরকেও বাঁচাতে সুন্দরবনকে দস্যু শূন্য করতেই হবে। এটা না করা পর্যন্ত , যদি একটাও বাহিনী থেকে যায় তাহলে সেটাই আত্মসমর্পণের পুরো প্রক্রিয়াকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। তাই আমি আমার প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলাম। আমার যত সূত্র জানা ছিল, সবকটা সূত্রকে ব্যবহার করা শুরু করলাম। করতেই হবে সুন্দরবনকে দস্যু মুক্ত। ফলে অনেকটা আক্রমণাত্মক মনোভাবে আমি আমার সুন্দরবন দস্যুমুক্ত  অভিযানে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম।

এই অবস্থায় সাগর বাহিনী নামে একটা বাহিনী আত্মসমর্পণে এগিয়ে এলো। এরা লোকালয়ের খুব কাছাকাছি, মংলা থেকে একদম কাছে করমজল-জোংড়া-মরাপশুর-ঝাপসি খালগুলোতে থাকতো। লোকালয়ের সামনে থেকেই তারা জেলেদের অপহরণ করে নিয়ে যেত। লোকবল ও অস্ত্রশস্ত্রের দিক থেকে তারা ছিল মাঝারি ধরনের দস্যুদল। বড় দস্যুদলগুলির মতো তারা সাগরে দস্যুতা করতে যেত না। স্থলের কাছাকাছিই তাদের দস্যুতার বলয়।

আমি সাগরের সঙ্গে দেখা করলাম ঝাপসির খালে। সেখানে তার সাথে আমার সারাদিন গল্প হয়েছিল।

সাগর বললেন — আপনি যখন বলবেন আমরা চলে আসবো।

আমি বললাম— আপনাদের নিয়ে ৱ্যাবের কাছে দিয়ে দেব। তারা আপনাদের আত্মসমর্পণ করাবে।

এই সাগর বাহিনীর আত্মসমর্পণের সাথে মিশে আছে এক দুঃসাহসিক ঘটনা। বলছি পরের পর্বে। 

(ক্রমশ)