পর্ব ৬
মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।
জঙ্গলে বাঘ, জলে কুমির আর জলে-জঙ্গলে সুন্দরবনের জলদস্যু। সুন্দরবনের জেলেদের জীবন চিরকালই দুর্বিষহ। তাঁরা মাছ ধরতে যান বনের খালে, নদীতে। আর প্রায়শই তাঁদের বাঘের আক্রমণ অথবা কুমিরের হামলার শিকার হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যু হয় অভাগা মানুষগুলির। কিন্তু অনেক সময়েই সেই মৃত্যু লিপিবদ্ধ হয় না সরকারি নথিতে। কারণ, তাঁদের কেউ কেউ বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে মাছ ধরতে আসেননি। তাঁদের কথা কেউ ভাবে না। এই জেলেরা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে মাছ ধরার পর বাড়িতে ফিরে আসতে পারেন। কিন্তু মাছ ধরতে গিয়ে রেহাই নেই জলদস্যুদের হাত থেকে। চলবে নিপীড়ন, অত্যাচার। টাকা দাও। মুক্তিপণ। তবে ছাড়া পাবে তুমি। আর মুক্তিপণ যদি একান্তই না দিতে পারো— মাছ রেখে যাও। এক অসহনীয় জীবন এই জেলেদের। ঠকাস! একটা গুলির শব্দ! বুক কেঁপে ওঠে জেলেদের। জীবনটা হাতের মুঠোয় নিয়ে রোজগার করতে হয় তাঁদের।
এই প্রসঙ্গে একটি ছোট তথ্য মনে করিয়ে দিই। বাংলাদেশ আজ চিংড়ি রফতানিতে পৃথিবীতে ষষ্ঠ। দেশের উন্নতিতে সুন্দরবনের জেলেদের দান বস্ত্রশিল্পের পরেই।
যাই হোক। গড়ইখালির মাছ ব্যবসায়ী মজিবর আমাকে ফোন করে জানালেন, আধঘণ্টার মধ্যে আমার ঠিকানায় পৌঁছবেন। একটা জিনিস খেয়াল করলাম— সময় না মেনে চলার একটা ব্যাধি আছে এঁদের। আধঘণ্টা বলে একঘণ্টা কেটে গেলেও দেখা নেই মজিবরের। যে নম্বর থেকে ফোন এসেছিল সেখানে ফোন করলাম আবার। না, ফোন বন্ধ। আরও কিছু সময় কেটে গেল। অবশেষে রাত আটটা নাগাদ ফোন এল। ফোনটা ধরে কথা বলতে বলতে দেখি সামনে উপস্থিত মজিবর। এসেই চারিদিকে দৃষ্টি দিলেন। বুঝতে পারলাম, কোনও সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ে কি না, দেখে নিচ্ছেন। যাই হোক, বোধহয় আমাদের ক্যারাম খেলতে দেখে একটু আশ্বস্ত হলেন। বললেন, ‘‘রাতে ভাটা হবে, তখন রওনা দেব আমরা।’’ এর মধ্যে ট্রলারের কিছু কাজ করতে হবে। সেই কাজ সম্পূর্ণ করে উনি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবেন। ব্যস, এইটুকু বলে কোথায় মিলিয়ে গেলেন।
আবার অপেক্ষা! অপেক্ষা করতে করতে আমাদের অবস্থা কাহিল। একদিকে উত্তেজনা, টেনশন সেই সাথে একটু একটু ভয়, ভিতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কারও সামনে প্রকাশ করা যাচ্ছে না। মজিবর যা বললেন তাতে আমাদের আরও দু-তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। কী করা যায় ? বেরিয়ে পড়লাম। ঘুরে আসি একটু এদিক-ওদিক। ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছে গেলাম খুলনার সন্ধ্যা বাজারে। মনে চিন্তা এল। যখন যাচ্ছি, কিছু নিয়ে যাই সঙ্গে করে। একেবারে খালি হাতে, বিষয়টা ঠিক দেখায় না। বাজারের যেখানে কাঁচা সব্জি বিক্রি হচ্ছে, সেখানে পৌঁছে গেলাম। কিনলাম টাটকা কিছু সব্জি। যতদূর মনে পড়ছে, প্রায় হাজার তিনেক টাকার মতো বাজার করেছিলাম আমি। তারপর বস্তা দুটোকে গাড়িতে তুলে আবার কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ালাম। তবে সতর্ক ছিলাম যাতে পরিচিতরা না দেখতে পারে।
রাত এগারোটা! ফোন এলো মজিবরের। একটু পরে কয়েকজন এসে উপস্থিত। আমাদের নিয়ে যাওয়া হল খুলনার রূপসা ঘাটে। বস্তাভর্তি কাঁচাবাজার ,ক্যামেরার যন্ত্রপাতি সবকিছু নিয়ে ট্রলারে উঠলাম। একটা জিনিস বুঝলাম, ওই ঘাটের সবাই জানে এই লোকগুলি দস্যুনেতা রাজুর সাগরেদ। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলেছে না। রূপসা ঘাটে প্রকাশ্যেই আনাগোনা ছিল দস্যুদের। রূপসা ঘাট থেকে রওনা দিলাম আমরা। একটু পরে ভৈরব নদীর ওপাশ থেকে আরও তিনজন উঠলো আমাদের ট্রলারে। তারপর আবার রওনা।
মধ্যরাত পেরিয়ে গিয়েছে। ট্রলার এগিয়ে চলছে। একটু গতিতেই চলছে যেন। ট্রলার জুড়ে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। একটু পরে পার হলাম রূপসা সেতু। তখন ট্রলারের পিছন থেকে উঠে এলেন একজন।হাত মেলালাম তার সাথে। তিনি আর এক দস্যুনেতা। রাজু গ্যাংয়ের ‘মেজভাই’ জাহাঙ্গীর। রাজুর বিশ্বস্ত সঙ্গী। আমাদের রাজুর কাছে নিয়ে যাবার মূল দায়িত্ব ছিলো জাহাঙ্গীরের উপরেই।
রাত আরও গভীর হল। খাওয়া হয়নি। রাতের খাবার ঠান্ডায় জমে গেছে। কোনওরকমে সেই ভাত খেয়ে নিলাম। প্রায় রাত দু’টো আড়াইটার সময় ট্রলার ভিড়ল গড়ইখালি স্লুইসগেটে।
আমাদের বিশ্রাম নেওয়ার জন্য কয়েকটি বালিশ-কাঁথা নেওয়া হল। ছ’টার মতো দেশি মুরগি আর বেশ কিছু বাজার-সদাই উঠিয়ে দিলো কিছু লোক। ট্রলার এবার রওনা দিলো দক্ষিণের দিকে।
একটু পরে ট্রলার দুলতে শুরু করলো। বুঝতে পারলাম, বড় নদীতে এসে পড়েছি। শিবসা নদী তখন বেশ উত্তাল। দেখলাম আশপাশের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি একটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে মোবাইলে গেম খেলতে খেলতে কাটিয়ে দিলাম সারা রাত। তবে মোবাইল নেটওয়ার্ক চলে গেছে অনেক আগেই।
কোথায় নিয়ে চলেছে আমাদের? আর কতক্ষণ? আর কতক্ষণ চলবে ট্রলার! আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছি, ভোর হবার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু যাচ্ছি কোথায়? একবার মনে হল, জিজ্ঞাসা করি। চুপ করে রইলাম। যদি সন্দেহ হয়। এরা কেমন ধারার লোক জানি না। আমাকে কেমন ভাবে নেবে সেটাও বুঝতে পারছি না। নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়।
ভোর হতে দেখলাম নদীতে তখন শেষ ভাটার টান। বেশ বড় একটা খাল ধরে এগোচ্ছিলাম।দু’পাশের বন জেগে উঠেছে। আসলে ভাটার টানে নদীতে জল কমে যাওয়ায় এমনটা মনে হচ্ছিল। যাই হোক, খালের নোনা পানিতে ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে ফেললাম। আমাদের ভিডিওগ্রাফার সোহেল রানাকে তারপর ঘুম থেকে উঠিয়ে দিলাম। ও ভোরবেলায় দুপাশের বন ও আমাদের অনেকগুলি ছবি তুললো। আরও কিছুক্ষণ চলার পরে দেখতে পেলাম ট্রলার। দূরের ‘দোয়া’-য় তিনটি বড় বড় ট্রলার। সঙ্গীদের ইশারায় ক্যামেরা বন্ধ করতে বললাম। সঙ্গী মংলার সাংবাদিক নিজাম উদ্দীন তখনও ঘুমে বিভোর। ডেকে তুললাম তাঁকেও।
সাধারণত কয়েকটি খালের মোহনাকে ‘দোয়া’ বলে স্থানীয়রা। এই জায়গাগুলি খুব প্রশস্ত হয়। ‘দোয়া’ কিন্তু সুন্দরবনের স্থানীয় জেলেদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ খালের যে কোনও জায়গার থেকে দোয়া-য় মাছ পাওয়া যায় বেশি। তাই জেলেদের মধ্যে দোয়ার দখল নিয়ে লড়াই চলে। তাছাড়া, ‘দোয়া’ নদীপথে, বনে চলাফেরার ক্ষেত্রে জায়গা চেনার জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
আর একটু এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, ওই দিক থেকে সাঁজোয়া বহর নিয়ে হাজির রাজুর বাহিনী। প্রায় ৭০/৮০ জন সশস্ত্র যুবক। সবাই তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে। কেউ ভাল চোখে দেখছে না আমাদের। সবার চোখ সন্দেহে ভরা। চেষ্টা করলাম ইগনোর করতে। আমার ট্রলার ভিড়তেই এগিয়ে গেলাম অন্য ট্রলারটির দিকে। একজন হাত বাড়িয়ে দিলেন। ভেবেছিলাম উনি বোধহয় দস্যু সর্দার রাজু হবেন। না, উনি রাজু নন। উনি নোয়া মিঞা। রাজু বাহিনীর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।আমাকে নিয়ে যাওয়া হল অন্য একটা ট্রলারে। সেখানে আমাকে হাত ধরে উঠিয়ে নিলেন বড় ভাই ওহিদ মিয়া।একটা কেবিনে বসালেন আমাকে। সেই কেবিনে ছিলেন আর একজন—তার নাম রাঙা মিয়া। আমাকে বসতে বললেন। তারপর এগিয়ে এলেন আরিফ। আরিফ কিছুক্ষণ ভাল করে পর্যবেক্ষণ করলো আমাকে। মিনিটখানেক পরে পাশের কেবিন থেকে একটা হাত বেরিয়ে এল। সেই রাজু! সুন্দরবনের মোস্ট ওয়ান্টেড রাজু। যাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের সমস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
অবশেষে পৌঁছে গেছি রাজুর ডেরায়।
(ক্রমশ)