পর্ব ১০
মোহসীন উল হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।
জ্ঞান হবার পর থেকে আমি বহু পত্রপত্রিকায় পড়েছি বা মিডিয়াতে শুনেছি জলদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযানের কথা। শুনেছি সেই সব অভিযানে নামকরা অনেক জলদস্যু মারা পড়েছে। আমরা বাংলাদেশের মানুষ সেই খবরগুলি শুনে বা পড়ে স্বস্তি পেয়েছি। কিন্তু কিছুদিন পরেই শুনেছি, সেই এলাকায় অন্য কোন দস্যুবাহিনী গজিয়ে উঠেছে। আগে হয়তো একটা ছিল, এখন হয়েছে তিনটে। আবার লুট শুরু হয়েছে সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে। কোনও দস্যুর মৃত্যুতে হয়তো সেই দল ভেঙে গেছে। কিন্তু কিছুদিন পরে দেখা গেছে সেই বাহিনীর লোকেরাই আবার ছোট ছোট উপদল গড়ে তুলেছে। অর্থাৎ এই অভিযান, ক্রসফায়ারে হত্যার পরেও দস্যুতা কমেনি। বরং উল্টোটাই । জেলেদের যদি আগে একটি দলকে তোলা বা চাঁদা দিতে হতো, জলদস্যুদের দল ভাগ হবার ফলে আরও বেশি দলকে তা দিতে হচ্ছিল। আমার আশ্চর্য লাগে, কেউ সেই বিষয়টি ভেবে দেখেননি। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ যেন ছিল শুধু জলদস্যুদের নিধন করা। জানি অনেকে আমার সমালোচনা করবেন, তবু বলি। এই জলদস্যুরাও আমার দেশের লোক, হতে পারে তারা ভুল পথে চালিত। কিন্তু তাদের ফেরার সব সুযোগ বন্ধ করে, ঘটনার গভীর অনুসন্ধান না করে, সুন্দরবনের জলদস্যু সমস্যার কোনও সুরাহা কোনওদিন হতো বলে আমি মনে করি না। আর একটি সংশয় আপনাদের সাথে আমি ভাগ করে নিতে চাই, যদিও এটা একান্ত ভাবেই আমার ভাবনা। সুন্দরবন জলদস্যু মুক্ত হোক— সত্যিই কি এই কামনা সবার মধ্যে ছিল? যাঁরা এই বিষয়টির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত ছিলেন, তাঁদের কথা বলছি। আর সন্দেহটা কেন হয়েছিল, সেটা পরে বলছি।
আপাতত একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। জানতে পারবেন, কীভাবে আমাদের দেশের সিস্টেম, একজন সাধারণ ছেলেকে জলদস্যুতে পরিণত করে। আমি ছেলেটির নাম বলবো না। নাম গোপন করে তার ঘটনা এখানে বলবো। ধরুন, ছেলেটির নাম মকবুল। ছোটবেলা থেকে আমি ওকে চিনি, আমার সাথে ঘোরাফেরা করতো। মংলার একটি গ্রামে তার বাড়ি। দরিদ্র পরিবারের ছেলে। আপন বলতে একমাত্র তার মা। যাই হোক, একদিন আমি খবর পেলাম মকবুল জেলখানায়। মকবুল জেলে ! আমি অবাক হয়েছিলাম। ওর মতো একটা ছেলে, জেলে যাবে কেন ? খোঁজ নিয়ে জানলাম, ঈদের ছুটির সময় মকবুল একটি ঝুপড়ি বাড়িতে বসে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে তাস খেলছিল। সেই সময় পুলিশ সেখানে হানা দেয় আর তাদের ধরে ফেলে। পুলিশ মকবুলকে কোর্টে চালান করে দেয়। মকবুলের ঘরে একা মা। আর কেউ নেই। আমাদের গ্রাম বাংলার সাধারণ ঘরের মায়েরা কী করে জানবেন আদালতের নিয়ম। তাই প্রথমদিন কোনও উকিল জোগাড় করতে পারেননি তিনি। উকিল না থাকায় জামিন মেলেনি মকবুলের। তারপর মকবুলের মা, ছেলেকে ছাড়ানোর জন্য নানা লোকের কাছে যান। কিন্তু ছেলেকে ছাড়াতে পয়সা চাই! কয়েকদিন কেটেও যায় এর মধ্যে। অবশেষে একজন উকিল ঠিক করা হয়। ১০০০০ টাকা লাগবে, তবে মকবুল জামিন পাবে। এত টাকা কোথায় পাবেন মকবুলের মা? চড়া সুদের তিনি টাকা ধার করেন এক স্থানীয় সুদখোর মহাজনের থেকে। প্রায় মাসখানেক পরে মকবুলের জামিন হয়। জামিন মেলার পরে মকবুলের দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যায়। মাথায় উপর সুদখোর মহাজনের টাকার বোঝা। আসলের সাথে প্রতিদিন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে সুদ। যাই হোক, মকবুল ভাবতে থাকে এই সুদ ও আসল কী ভাবে মেটাবে।
সেই সময় ছিল দুবলার চরের শুঁটকির মৌসুম। মকবুল একটা মাস মাহিনার ভিত্তিতে কাজ নিয়ে চলে যায় দুবলার চরে। প্রায় তিনমাস সেখানে কাজ করে। এদিকে কোর্টে নিয়মিত মকবুলের কেস উঠছে, তার বাড়িতে সমন আসছে, কিন্তু সে কোর্টে অনুপস্থিত। কোনও হাজিরা নেই। মকবুল হয়ে গেল ফেরারি আসামি। একদিন বাড়ি ফিরে এলো মকবুল। ফিরে এসেও বাড়িতে থাকতে পারলো না। পুলিশের সোর্স এইবার তাকে বিরক্ত করতে শুরু করলো। কোনও উপায় না পেয়ে মকবুল চলে গেল চট্টগ্রামে। দিনমজুরের কাজ নিয়েছিল ছেলেটা। কিন্তু বেতন অতি কম। একজন মানুষের দিন চলে না ওই টাকায়। আর কোনও উপায় না পেয়ে চট্টগ্রামের কাছে সাগরবাহিনী বলে জলদস্যুদের একটি বাহিনীতে যোগ দেয় মকবুল। জলদস্যু বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সময় সেই দলের নেতারা অনেক টাকার লোভ দেখায়। কিন্তু বাস্তবে হয় উল্টো। যাই হোক, মকবুল ভাবে, অল্প সময়ে অনেক টাকা রোজগার করবে, মিটিয়ে দেবে মহাজনের টাকা। এই ভাবে একটি সাধারণ নিরীহ ছেলে একটা পেটি কেসে আটকে গিয়ে হয়ে গেল জলদস্যু।
আমি ওই বাহিনীটিকে আত্মসমর্পণ করাতে গিয়েছিলাম যখন, মকবুলকে তখনই আবিষ্কার করি। ওদের ওখানে গিয়ে দেখি, মকবুল ওই দলের সাথে যুক্ত। যদি কোনওদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রসফায়ারে মকবুলের মৃত্যু হতো, তবে সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে থাকতো— মৃত্যু হয়েছে সুন্দরবনের এক কুখ্যাত ডাকাতের।
কাহিনীর মূল পর্বে ফেরা যাক।
রাজুবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানের দু’দিন পরে আমাকে ফোন করলো রাজু।
-ভাই, আমি ভাল হতে চাই, আর আপনারা আমাকে এই ভাবে…আমি তো আপনাদের আশাতেই ছিলাম, আমি তো আশা ছাড়িনি। আমি ভেবেছিলাম যে আপনি আমার আত্মসমর্পণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এদিকে ৱ্যাব এভাবে…। যাই হোক ভাই, আমি এখানে থাকবো না, অস্ত্রশস্ত্র বুঝিয়ে দিয়ে চলে যাবো।
এর তিনদিন বাদেই পরিবারের লোকজনকে নিয়ে রাজু অজ্ঞাতবাসে চলে গেল। জলদস্যুদের আত্মসমর্পণ করাতে আমার চেষ্টায় আর একবার বাধা পড়লো।
মোতালেব চেয়েছিল আত্মসমর্পণ করতে। ক্রসফায়ারে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর। তারপর রাজু চলে গেল অজ্ঞাতবাসে।
কিছু প্রশ্ন জাগে মনে। এমতাবস্থায় কী করা উচিত? হাল ছেড়ে দেব? ভাবলাম, না! এতো সহজে নয়। হাল ছাড়বো না। আবার চেষ্টা করবো। যতবার ব্যর্থ হবো, ততবার চেষ্টা করবো।
রাজু চলে যাবার সময় তার বাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল রামপালের শহীদুলকে। আমি চেষ্টা করলাম শহীদুলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কী করে শুরু করি?
মংলার জোড়া ব্রিজ-এর মাছ ব্যবসায়ী ও পুলিশের সোর্স মনা ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করি। দস্যুনেতা শহীদুলের সঙ্গে তার দারুণ খাতির! পুরনো ব্যবসায়ীদের উঠিয়ে দিয়ে তখন মনার জেলেরা শুধু মাছ ধরছিলো সুন্দরবনের ঝাপসী-ভদ্রায়। বড় দস্যুদলের বিশ্বস্ত লোকজনই এখানে মাছ ধরার সুযোগ পেতো।
মনা ভাইকে বললাম, শহীদুলের সাথে দেখা করতে হবে। কথা বলতে হবে। আত্মসমর্পণ করানোর জন্য রাজি করাতে হবে ওকে। চালিয়ে গেলাম কথাবার্তা।
রাজি হল শহীদুল।
কিন্তু এইবার আপত্তি এল রাজুর কাছ থেকে। সুন্দরবন ছেড়ে চলে গেলেও বাহিনীর পুরো নিয়ন্ত্রণ তখনও রাজুর হাতে। অজ্ঞাতবাস থেকে তার নির্দেশ এলো, কোনওভাবেই আত্মসমর্পণ করা চলবে না।
কিছুদিন আগেই ৱ্যাব অভিযান চালিয়েছে রাজু বাহিনীর উপর। সেই ভয়াবহতা তাদের মনে গেঁথে আছে। তাই আত্মসমর্পণ নিয়ে বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যই দ্বিধায় ছিল। কিন্তু শহীদুল এবার নিষ্কৃতি চায়। আর ভাল লাগছে না এই জঙ্গলের জীবন। আত্মসমর্পণ করতে চায় সে। সব সময় মৃত্যুভয়। অন্যদিকে গ্রামে স্বজনদের উপরে স্থানীয় মাতব্বরদের অত্যাচার চলছে। শহীদুল মনস্থির করে ফেলেছে— সুযোগ পেলেই আত্মসমর্পণ করবে।
শহীদুলের সঙ্গে কথাবার্তা চুড়ান্ত করে আমি ঢাকা থেকে মংলায় পৌঁছলাম। পরদিন বনে যাবো, দেখা হবে দস্যুদলটির সঙ্গে। কিন্তু সেই সন্ধ্যায় বন্ধ হয়ে গেলো শহীদুলের সব নাম্বার। কোনও খবর পেলাম না শহীদুলের।
কয়েকদিন পর খবর এলো— ক্রসফায়ারে মারা গেছে শহীদুল নামে এক জলদস্যু।
(ক্রমশ)
Hi