পর্ব ১৪
মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন । ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশ টিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন । প্রান্তিক মানুষের জীবন জীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন । সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।
দীর্ঘ সময়ের ক্লান্তির পরে বাকি রাতটা আমরা কাটালাম ঝাপসির দোয়ায়। পরদিন সকাল হতেই আবার চলা শুরু। কিছুক্ষণ চলার পরে ভদ্রা নদী পেরিয়ে আমরা পড়লাম আদাচাকির (আদাচাই) ভাড়ানীতে। এই ভাড়ানী ধরে এগিয়ে গেলে পৌঁছে যাবো শিবসায়। সেখানে বন বিভাগের একটি অফিস আছে। ওই জায়গায় পৌঁছতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। কিন্তু সেখানেও এক বিপদ। বনকর্মীরা আটকে দিলেন আমাদের। এই যাত্রায় দেখছি পদে পদে বাধা।
তবে ভাগ্য ভাল আমাদের। আদাচাই বনটহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত অফিসার যিনি ছিলেন, সেই মোস্তফা ভাই আমার পূর্বপরিচিত। কথা বললাম তাঁর সঙ্গে। সেই সাথে কথা বললাম অন্য বনকর্মীদের সঙ্গেও। জানালাম আমাদের উদ্দেশ্যের কথা। তারপর বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। ওখান থেকেই ফোন করলাম দস্যুনেতা ইলিয়াসকে। কথা হল তার সাথে। যাই হোক, ফাঁড়ির অনুমতি পেলাম। বিকেল পাঁচটার দিকে আবার রওনা দিলাম। শিবসা থেকে দক্ষিণ দিকে। কথা ছিল শিবসার পূর্ব পাশ ধরে এগিয়ে যাবো, আর পথে সংকেত দিয়ে ডেকে নেবে দস্যুদল।
লম্বা পথ। ভাটায় পানি নেমে যাওয়ায় আমরা চলেছি একেবারে শিবসা নদীর মাঝখান দিয়ে। হঠাৎ করে সারা আকাশ ছেয়ে গেল ঘন কালো মেঘে। এই সফরে যেন দুর্যোগ আমাদের পিছু ছাড়ছে না। যা মেঘ করেছে, তাতে তুমুল বৃষ্টির সম্ভাবনা। এইটুকু ট্রলার! এগারো জন যাচ্ছি। ভিজে নেয়ে একশা হয়ে যাবো। তারপর যদি বৃষ্টির বেগ বেশি হয়, সামলানো যাবে তো ট্রলার! উত্তাল নদী হিসাবে শিবসার বেশ নাম ডাক রয়েছে। নানা আশঙ্কা দেখা দিলো মনের ভেতরে। কিন্তু কপাল সহায় আমাদের। একটু পরেই মেঘ কেটে গেল। আমরা এগিয়ে গেলাম।
এই ভাবে চলতে চলতে রাত প্রায় ন’টার সময় সামনের দিকে দেখতে পেলাম একটা টর্চের আলো। ওটা সংকেত। আমাদের ট্রলার এবার চলতে শুরু করলো বড় নিশানখালী খালের দিকে। তারপর কিছুক্ষণ। আমরা পৌঁছে গেলাম দস্যু বহরের কাছে। একটু পরে দেখা হবে ওই সময়ে সুন্দরবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দস্যুবাহিনী ইলিয়াস বাহিনীর সঙ্গে।
সেখানেই দেখা হয়েছিল ইলিয়াসের সাথে। বাহিনীটি বেশ বড়। লোকবলে, আবার অস্ত্রবলেও। দেখলাম, বেশির ভাগ আমার পূর্ব পরিচিত। তিনদিন ছিলাম সেখানে। দফায় দফায় বোঝানোর চেষ্টা করলাম “আত্মসমর্পণ করুন”। কিন্তু কিছুতেই রাজি হল না ইলিয়াস।
এই ইলিয়াসের সাথে দেখা করার সফরটি খুব বৈচিত্র্যময়। সবাই বলে আমি নাকি জলদস্যুদের প্রতি ভীষণ ভাবে দুর্বল। দেশের সুরক্ষার কথা না ভেবে শুধু ওদেরকে নিয়ে চিন্তিত। সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষদের কথা ভাবার সময় আমার নেই। সবটাই উপর দেখানো। যাই হোক, কাজের সমালোচনা থাকে। তবে আজ একটা ঘটনা বলবো— এই ইলিয়াস বাহিনীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আমার সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা। তারপর আমি বলব আমার মনের কথা।
মনে রাখবেন, সুন্দরবনের জেলে, মাওয়ালী বা বাওয়ালীদের বেঁচে থাকার একটাই অবলম্বন। সেটা হল সুন্দরবনের সম্পদ। সুন্দরবনের মাছ, কাঁকড়া, গোলপাতা, মধু— এই সব সম্পদ সংগ্রহ করে বেঁচে থাকেন তাঁরা।
আমি যখন ইলিয়াসের সঙ্গে দেখা করতে যাই, সেই সময় তারা একটি ট্রলার আটক করেছিল। সেই ট্রলারে ছিল প্রচুর মধু। কতটা? আমার অনুমান, প্রায় দুশো-তিনশো মণ। প্রথমে বলে নিই, এই মধু কীভাবে সংগ্রহ হয়েছে। খুলনার একজন মধু ব্যবসায়ী। তিনি একটি ট্রলার নিয়ে যান সুন্দরবনে। সেখানে আছে অনেক মৌয়াল। আর তাদের ভরের নৌকা। সেই ভরের নৌকা করে মৌয়ালরা সুন্দরবনের জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করে মধু। আর সেই মধু তারা এনে জমা করে ট্রলারে। সুন্দরবনে ঢুকে মধু সংগ্রহ করতে টাকা দিতে হয় দস্যুবাহিনীদের। এই ট্রলারের লোকেরাও টাকা দিয়েছিল। নোয়া বাহিনীকে। ট্রলারটি যাচ্ছিল শিবসা নদীর অপর দিক দিয়ে। যেটা নোয়া বাহিনীর এলাকা। ইলিয়াস বাহিনী ওই নোয়া বাহিনীর এলাকা থেকে ট্রলারটিকে জোর করে নিয়ে আসে নিজেদের এলাকায়। আটক করে সমস্ত মধু। ওদের অপরাধ, ওরা ইলিয়াস বাহিনীকে টাকা দেয়নি।
আটক করা ট্রলারে ছিলেন এক বৃদ্ধ মানুষ। উনি দেখভাল করছিলেন পুরো ট্রলার। যেহেতু মধু সংগ্রহকারীরা টাকা দেয়নি, তাই পুরো মধু বাজেয়াপ্ত করলো ইলিয়াস বাহিনী। ভেবে দেখুন, প্রায় দুশো-তিনশো মণ। সেই মধু নিয়ে নিল ইলিয়াস বাহিনী। আমি বারবার অনুরোধ করেছিলাম ট্রলার ছেড়ে দেওয়ার জন্য। আমি বললাম, কিছু একটা এডজাস্টমেন্ট করে ট্রলার ছেড়ে দিন। আমার কথা শোনেনি তারা। সেইদিন আমার ভীষণ খারাপ লেগেছিল। এতটা মধু! এতগুলি লোকের রুজি রোজগার! সব শেষ হয়ে যাবে যদি ওই মধু ওরা নিয়ে যেতে না পারে। আমি ফিরে আসার সময় আরও কয়েকবার অনুরোধ করেছিলাম ওই ট্রলারটি যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। ফিরে আসার পরে জানতে পারি, ইলিয়াস বা জাহাঙ্গীর— কোনও দস্যুরাই রাজি হয়নি। পুরো মধুটাই ওরা বাজেয়াপ্ত করেছিল। কী হল এর ফলে? ওই যে মৌয়াল দল। জীবনটাই শেষ হয়ে গেল মানুষগুলির। ওরা দাদন নিয়ে, সুদের টাকা নিয়ে গিয়েছিল মধু সংগ্রহ করতে। মধু নেই। টাকা শোধ করবে কি করে?
এবার বলি আমার মনের কথা। ভেবে দেখুন, সুন্দরবনের গহীনে জলদস্যুদের হাতে বাজেয়াপ্ত হল মণ মণ মধু। সেই মধু নিয়ে কি করবে ওরা? নিশ্চয় মধু বিক্রির জায়গা আছে ওদের। কোনও মাধ্যম দিয়ে সেই মধু পৌঁছে যাবে নির্দিষ্ট লোকেদের কাছে। সবাই জানে এগুলি চোরাই মধু। সেই চোরাই মধু নিয়ে কেউ কোনও কথা বলবে না। কারণ, ওই মধুর ভাগ পৌঁছবে নির্দিষ্ট ঠিকানাগুলিতে। জলদস্যুরা থাকবে তাদের মতো, আর বাকি সিন্ডিকেট থাকবে তাদের মতো। সব চলবে আগের মতো। সব ঠিকঠাক। কিন্তু কারা শেষ হবে? একবার প্রশ্ন করুন নিজেদের। কারা শেষ হল? সুন্দরবনের ওই প্রান্তিক মানুষগুলি, যাদের একটাই কাজ— মধু সংগ্রহ করা। সেই মধু তাদের জীবনের শেষ আশা, সেটাই কেড়ে নিয়েছিল দস্যুদল। ধ্বংস হয়েছে গোটা কয়েক পরিবার। কারও কিছু যায় আসেনি তাতে। সুন্দরবনে দস্যুরা থাকলে সিন্ডিকেট থাকবে আর সিন্ডিকেট থাকলে সুন্দরবনের মানুষগুলিকে চুষে খেতে পারবে এক শ্রেণীর লোক। জলদস্যু বাহিনী এমনিতে শেষ হয় না। যতই ক্রসফায়ার করো, দস্যুরা থেকেই যায়। সেটাও ওদের বাধ্যবাধকতা। একবার জলে নামলে, ওই জলদস্যুর নৌকায় চড়লে আর ডাঙায় ওঠা যাবে না। এটাই প্রায় অলিখিত নিয়ম ছিল সুন্দরবনে। কেউ যদি সেই নিয়ম থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, তবে ওই সিন্ডিকেট চক্র যেভাবে হোক চেষ্টা করে এদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে। এটাই বাস্তবতা সুন্দরবনের।
কিন্তু কীভাবে মুক্তি মিলবে? পথ একটাই। জেলেরা ভয় পায় জলদস্যুদের। জলদস্যুরা জানে ওরাও কলের পুতুল। যে কোনও সময়, যে কোনও দিন একটু বেগরবাই করলেই তাদের জীবনও শেষ হয়ে যাবে। একমাত্র উপায় যদি সরকার উদ্যোগ নেয়। যদি পুনর্বাসনের কোনও প্যাকেজ দিয়ে জলদস্যুদের সাধারণ জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়। সিন্ডিকেট তবেই খতম হবে। সুন্দরবনের মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারবে। সুন্দরবন মুক্ত হবে এই সিন্ডিকেটের পাপ থেকে।
সুন্দরবনের জলদস্যু শুধু যারা জলে বাস করে তারাই নয়, ডাঙার উপরেও অনেক দস্যু আছে। বেশির ভাগ সময়ে জলের দস্যুদের নিয়ন্ত্রণ করতো তারাই। তারাই সর্দার তৈরি করে, তারাই সর্দারের পিছনে খোচর তৈরি করে। বলবো সে সব কথা আগামী পর্বগুলোতে।
(ক্রমশ)
ভালো লাগলো প্রিয় ভাই