পর্ব -৫

মোহসীন-উল-হাকিম ২০০০ সাল থেকে সাংবাদিকতা করছেন। ২০০৯ সালে আইলা ঝড়ের পরে বাংলাদেশের দেশটিভির প্রতিবেদক হিসেবে সুন্দরবনে পৌঁছন। প্রান্তিক মানুষের জীবনজীবিকা নিয়ে তিনি কাজ করে চলেছেন। সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।তাঁর মধ্যস্থতাতেই ৩২৮জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছেন ।

লোকে বলে আমি খুব জেদি। যদি মনে করি কোনও একটা কাজ করবো, তবে সেটাই ধ্যান জ্ঞান হয়ে যায় আমার। আইলার রিপোর্টিং করে ফিরে আসার সময়েই স্থির করেছিলাম, সুন্দরবনের যে অসহায় মানুষেরা বনদস্যু বা জলদস্যুদের ভয়ে এক নারকীয় জীবন কাটাচ্ছে, তাদের একটা সুন্দর জীবন দিতে হবে।

একটি বার এই মানুষগুলির অবদান দেখুন দেশের সমৃদ্ধিতে, আমাদের ভাল রাখার জন্য কি-না করেন তারা। আজ ডিজিটাল যুগ, ‘বাংলাদেশের জেলেরা’ লিখে খোঁজ করে দেখুন, কী তাদের অবদান অর্থনীতিতে। বাংলাদেশের উন্নতির পাঁচ শতাংশ নির্ভর করে এই জেলেদের উপরে। প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আসে এদের ধরা মাছ রপ্তানি করে। দেশের প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ জড়িত এই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে, তার মধ্যে প্রায় ১৪ লক্ষ মহিলা। এই যে আমরা শহরের সাধারণ মানুষ ভাল মাছ পাই, কাদের জন্য?  যদি এদের এতটা অবদান থাকে দেশের জন্য তবে তাদের কি ইচ্ছে করে না একটু ভাল ভাবে বাঁচার, অন্তত দু-বেলা খাবার খেয়ে পেট ভরানোর।

আবার এদেরই মধ্যে কেউ কেউ সেই জীবনের যন্ত্রনা সহ্য না করতে পরে বেছে নিচ্ছে জলদস্যুর পেশা। গোটা পরিবেশকে বিষিয়ে তুলছে তারা। পরিস্থিতি একেবারে ভয়াবহ। কী ভাবে এদের বাগে আনা যায়, সেই চিন্তা মনের মধ্যে সব সময়েই কাজ করছিল।

সুন্দরবনে মানবিক বিপর্যয়ে বিধস্ত জেলেরা

এখন বলতেই পারেন, দেশে প্রশাসন আছে, তারা তো চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না, প্রতিনিয়ত পরিকল্পনা করছে কী করে জলদস্যুদের বাগে আনা যায়। তুমি কেন? ইতিহাস ঘাঁটুন, ১৪৯৮ সালে পর্তুগিজরা যখন অবিভক্ত ভারতে আসে, তারা সঙ্গে এনেছিল জলদস্যু পেশা। চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলেছিল তাদের জলদস্যু বৃত্তি। তারপর থেকে সেটা কোনও ভাবেই আটকানো যায়নি। সেই সময়ে আমাদের বাংলাদেশের প্রশাসন জলদস্যুদের বিরুদ্ধে অভিযান করেছে, ক্রসফায়ারে মারা গিয়েছে বহু জলদস্যু। কিন্তু খবর পাচ্ছি, কোনও ভাবেই  এদের সংখ্যা কমছে না। বরং উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। হ্যাঁ, চেষ্টা হয়েছে অনেক, তবুও বন্ধ তো হয়নি জলদস্যু প্রথা। আমার জেদ, অন্যরকম ভাবে চেষ্টা করবো। জলদস্যুরাও তো এই বাংলাদেশেরই মানুষ। তাদের নিকেশ না করে তাকে সাধারণ জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা যেতেই পারে। আর সেই কাজের জন্য আমার দরকার একটা উদাহরণ।একবার ফ্লাডগেটটা খুলতে হবে।

অফিসকে জানালাম, আমি দস্যু সম্রাট ছোট রাজুর কাছে যাবো। তার সাক্ষাৎকার নেবো। কোনও কথা শোনার আগেই না বলে দিলো আমার অফিস। একেবারে আমল দিল না আমার প্রস্তাবে। এত দিনের চেষ্ঠায় রাজি করালাম রাজুকে! অফিসের কারণে সেই সুযোগ হারাবো? ওই যে শুরুতে বলেছিলাম, বিরাট জেদ আছে আমার। আমিও লেগে পড়লাম। কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করলাম, আমাকে যেতে দিন। এরই মধ্যে রাজু জানিয়ে দিয়েছে, কবে ও আমার সাথে দেখা করবে। সময় ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু অফিস অনুমতি দিচ্ছে না।

নির্ধারিত দিন চলে এসেছে। কালকেই আমাকে ঢাকা ছাড়তে হবে। কিন্তু অফিস তো এখনও অনুমতি দিল না। আবার দরবার করলাম। তখনও কর্তৃপক্ষ অনড় তাঁদের সিদ্ধান্তে। রাত আটটা বাজে। যেতে হলে কাল সকালেই। অনেক ঝক্কি সামলে জলদস্যুরা সময় দেয়। কারণ, জোয়ার-ভাটা-দূরত্ব-রিস্ক সবকিছু বুঝে শুনে ওরা সময় নির্দিষ্ট করে, যদি এইবার দেখা না করতে পারি! আর সুযোগ পাবো তো? আমি আবার চেষ্টা করলাম। অনুমতি পেতেই হবে!

অবশেষে পেলাম অনুমতি। অনেক রাতে অফিস জানাল, আমি যেতে পারি। পরদিন আমি রওনা দেব সুন্দরবনে রাজুর ডেরার উদ্দেশে। সুন্দরবনের মোস্ট ওয়ান্টেড জলদস্যু রাজু মোল্লা। বিরাট ব্যাপার। ভিডিওগ্রাফার সোহেল রানা সঙ্গী হলেন সেই যাত্রায়। বেরিয়ে পড়লাম। সারাটা দিন জার্নি করে সন্ধে নাগাদ পৌঁছলাম মংলায়। ওখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন। কথা ছিল মংলায় পৌঁছানোর পরে একটা সংকেত আসবে। সময় কেটে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে রাত বাড়ছে। কিন্তু সংকেত আসছে না। ফোনে চেষ্টা করলাম। ফোন বন্ধ। কী করি? অফিসে রীতিমত যুদ্ধ করে অনুমতি নিয়েছি। ভাবছিলাম, যদি রাজুর সংকেত না আসে?  যদি দেখা না হয়! অফিসে তো মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। এবার রীতিমত দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার। আসবে তো সংকেত ! নানারকম উল্টোপাল্টা চিন্তা শুরু হলো মাথায়। কিন্তু কি করবো? অপেক্ষা ছাড়া তো কোনো উপায় নেই আমার।

পরদিন দুপুর গড়িয়ে এল একটি ফোন। একদম নতুন একটি নম্বর থেকে। ফোনে নির্দেশ পেয়ে সাথে সাথে ব্যাগ বোচকা গুছিয়ে রওনা দিলাম। গন্তব্যস্থল খুলনা। পৌঁছেও গেলাম। ওখানে আমাদের বলা হল অপেক্ষা করতে হবে, আর পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত কোথাও যাওয়া যাবে না। আবারও প্রতীক্ষা। পরে বুঝেছি, মংলায় আমার গতিবিধি লক্ষ্য রাখছিলেন এক সাংবাদিক। ৱ্যাব বা পুলিশের সাথে যোগাযোগ করছি কি না, সেটাই দেখছিলেন তিনি। যখন বুঝতে পেরেছিলেন, আমি কারও সঙ্গে যোগাযোগ করছি না তবে আমাকে সংকেত দেওয়া হয়।

অপেক্ষা আর অপেক্ষা

যাই হোক, এখন আমরা খুলনায়। সময় কাটছে শুয়ে বসে। কী করি ? আমার এক সহকর্মী মোস্তফা জামাল পপলু ভাইদের একটা ক্লাব আছে শিববাড়ি মোড়ে। গেলাম সেখানে। বিকেলটা ক্যারাম খেলে কাটিয়ে দিলাম। সন্ধের পর পর একটা ফোন নম্বর দেওয়া হল আমাকে। রাজু ফোন করেছিল। বলল, একজন মাছ ব্যবসায়ী যোগাযোগ করবেন আমার সঙ্গে। এরপর থেকে উনিই আমাদের গাইড। নিয়ে যাবেন  সুন্দরবনে রাজু মোল্লার ডেরায়। সারাদিন খুলনায় থেকে একটা জিনিস পরিস্কার হল আমার কাছে, আমাদের প্রতিটি মুহূর্তের খোঁজ রাখছে রাজু। কি করছি, কোথায় কোথায় গেছি , কোথায় দুপুরে খেয়েছি, সব খবর পৌঁছে যাচ্ছে রাজুর কাছে। তার লোকজন আমাদের ঘিরে রেখেছে। বলা যায় সারাদিন নজরদারি চালানো হয়েছে আমাদের উপরে। 

রাজু ফোন করার মিনিট খানেক পরে আর একটা ফোন এলো আমার কাছে। পরিচয় দিলেন মজিবর, গড়ইখালির মাছ ব্যবসায়ী তিনি। রাজু বলেছিল, উনি এবার থেকে আমাদের পথপ্রদর্শক।

গভীর রাতে রওনা দেব রাজুর ডেরার উদ্দেশে। সঙ্গে থাকবেন।