অনিন্দ্য শর্মা
ছোটদের অঙ্কের ক্লাস।
অঙ্ক শিক্ষক বিপ্রদীপবাবু— রত্নবিজয়, তোমার এবারের ক্লাস টেস্টের খাতায় দেখা যাচ্ছে— অঙ্কের যোগের জায়গায় কিছু গন্ডগোল আছে।
রত্নবিজয়— কেন স্যার, আমি তো ঠিকই লিখেছি।
বিপ্রদীপ— না বাবা, আমি কিন্তু তোমার যোগের ক্ষেত্রে ভুল দেখতে পাচ্ছি।
রত্ন— কেন স্যার?
বিপ্র— আচ্ছা, বল তো বিজয়— দুই আর দুইয়ে কত হয়?
রত্ন— বাইশ
বিপ্র— ঠিক বলছো?
রত্ন— হ্যাঁ
বিপ্র— না ঠিক না বাবা। তুমি ভুল বলছো। ২ আর ২-এ বাইশ হয় না, চার হয়।
রত্ন— না! আপনি জানেন না! ২ আর ২-এ বাইশ হয়।
বিপ্র— আচ্ছা ঠিক আছে। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, ধরো তোমার কাছে ২টো বল আছে। আর আমি তোমাকে দু’টো বল দিলাম। এবার বলো তো তোমার কাছে ক’টা বল থাকবে?
রত্ন— একটাও না! কারণ, আমার কাছে তো কোন বলই নেই।
বিপ্র— না ধরো, আমি যদি তোমাকে দু’টো বল দি আর তোমার কাছে দু’টো বল থাকে।
রত্ন— অত ধরতে পারবো না স্যার। কিন্তু আমি জানি ২ আর ২ এ বাইশ হয়। এটাই ঠিক।
রত্নবিজয় ক্লাস থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
পরদিন বিপ্রদীপ টিচার্স রুমে বসে আছেন। সেই সময় স্কুলের দারোয়ান এসে দাঁড়াল বিপ্রদীপের সামনে।
দারোয়ান— স্যার, আপনার সঙ্গে রত্নবিজয়ের বাবা-মা দেখা করতে এসেছেন।
বিপ্র— তুমি ওদের আমার ঘরে পাঠিয়ে দাও।
ঘরে প্রবেশ করলেন এক দম্পতি। একজন রত্নবিজয়ের মা আর একজন রত্নবিজয়ের বাবা বিদ্যাসূদন।
বিপ্র— নমস্কার। আসুন, এখানে বসুন।
—নমস্কার, আমি এখানে বসতে আসিনি ।আমি হলাম রত্নবিজয়ের মা রত্নজায়া দত্ত আর এই আমার স্বামী বিদ্যাসূদন দত্ত। ইনি এই রাজ্যের এক বিধায়ক।
—বিদ্যাসূদন? আপনার নাম?
বিদ্যা— হ্যাঁ, বিদ্যাসাগর আর মধুসুদন আমার আইডিয়াল। তাই আমার নাম বিদ্যাসূদন।
বিপ্র— ও আচ্ছা। তা আপনারা কেন এসেছেন যদি বলেন?
রত্নজায়া— দেখুন, আমরা জানতে পেরেছি আপনি আমার ছেলের ম্যাথ টেস্টে কোনও নম্বর দেননি। কি ঠিক বলছি?
বিপ্র— হ্যাঁ, দেখুন ও কিন্তু অঙ্কে খুব কাঁচা, যোগটা একদম করতে পারে না, ওর ভাল গাইডেন্স দরকার।
রত্ন জায়া— কী বলতে চান আপনি? আমার ছেলে অঙ্ক পারে না? সাহস হয় কি করে আপনার এই কথা বলার! হাউ ডেয়ার ইউ!
বিপ্র— আপনি জানেন, আপনার ছেলে ২ আর ২ বাইশ বলছে!
বিদ্যা— যা ইচ্ছা বলতে পারে ও। আর আপনাকে কে বলেছে, ২ আর ২ এ বাইশ হয় না! প্রমাণ করুন আপনি।
রত্নজায়া— জানেন ও কোন বংশের ছেলে, ওর বাবা এই রাজ্যের বিধায়ক! আর আপনি তার ছেলের ভুল ধরছেন। এতো বড় সাহস আপনার। জানেন আমি কি করতে পারি। আমি আপনার নামে প্রিন্সিপালের কাছে কমপ্লেন করবো। আপনি একটা দুধের শিশুকে শূন্য দিলেন? একটু মানবতা নেই আপনার!
বিপ্র— কী বলছেন এসব? আপনার ছেলে ২ আর ২ বাইশ বলবে আর আমাকে নম্বর দিতে হবে?
বিদ্যা— হ্যাঁ, দিতে হবে। একটা কথা মন দিয়ে শুনুন, আপনার মাইনে হয় আমরা এই স্কুলে ছাত্র ভর্তি হতে দিই বলে। একদম বেচাল করবেন না।
বিপ্র— এটা ঠিক বলেছেন। কিন্তু আমাকে তো মাইনে দেওয়া হয় ছাত্রদের সঠিক শেখানোর জন্য।
বিদ্যা— রাখুন মশাই, সঠিক! শুনুন, কালকের মধ্যে যদি আমার ছেলের নম্বর না বাড়ে তবে আপনার কপালে অশেষ দুঃখ আছে। আর একটা কথা মাথায় রাখবেন। এই স্কুলের অ্যাফিলিয়েশন কিন্তু আমরা দিই। আর যদি আপনি পুরো নম্বর না দেন, কী করে স্কুলের অ্যাফিলিয়েশন থাকে সেটাও আমি দেখে নেব। চলো জায়া, প্রিন্সিপালের কাছে চলো।
একটু পরে প্রিন্সিপালের কেবিনে।
প্রিন্সিপাল— করেছেনটা কি আপনি? ছেলেটাকে একেবারে শূন্য দিয়ে দিয়েছেন?
বিপ্র— কি করবো বলুন তো? কেউ যদি ২ এ ২ বাইশ লেখে, তাকে নম্বর দেওয়া সম্ভব?
প্রিন্সিপাল— কেন সম্ভব নয়? কোন অভিধানে আছে যে ২ এ ২ এ বাইশ হয় না?
বিপ্র— এটা আপনি কি বলছেন স্যার! ২ আর ২ এর যোগফল বাইশ?
প্রিন্সিপাল— আপনি খুব পড়াশুনা করেছেন না! সব জানেন? আচ্ছা বলুন তো, স্কুল বানান কি?
বিপ্র—মানে?
প্রিন্সি— মানে কিছু নয়। স্কুল বানানটা বলুন।
বিপ্র— এস সি এইচ ডবল ও এল.
প্রিন্সিপাল— ডবল ও মানে!
বিপ্র- দুটো ও!
প্রিন্সিপাল— দু’টো ও বললেন না! এই বার বলুন, কোন ও টা আগে বসবে আর কোনটা পরে?
বিপ্র—মানে?
প্রিন্সিপাল—দু’টো তো ও বললেন, সেখানে প্রথম ও কোনটা আর দ্বিতীয় ও কোনটা?
বিপ্র—কি!
প্রিন্সিপাল—বাংলা ভাষা বোঝেন না? একজন শিক্ষক হয়ে আপনি স্কুল বানান পারেন না আর একটা ছেলের খাতায় শূন্য বসিয়ে দিচ্ছেন? যান, ওর খাতায় নম্বরটা বাড়িয়ে দিন, যান।
বিপ্র— ২ আর ২ যোগ বাইশ বলবে আর আমাকে নম্বর দিতে হবে!
প্রিন্সিপাল— হবে। দিতে হবে। আপনি অঙ্কের টিচার তো! ৫০০ জন ছেলে মেয়ে ইনটু ৫০০০— এই গুণটা জানেন? আপনার বেতনের চাবিকাঠিটা জানেন? শুনুন, কখনও কখনও ২ আর ২ যোগ করে বাইশ করতে হয়। আর এটার নাম হল অ্যাডজাস্টমেন্ট। যান, নম্বরটা বাড়িয়ে দিন।
বিপ্র— কিন্তু আমার এতদিনের শিক্ষা? আমার রেসপেক্ট!
প্রিন্সিপাল— রাখুন মশাই আপনার শিক্ষা। কী করতে পেরেছেন ওই শিক্ষা শিক্ষা করে। কাল চাকরি না থাকলে খাবেন কি? আপনার রেসপেক্ট আপনার শিক্ষা আপনাকে ভাত দেবে?
বিপ্র— কি বলছেন এই সব! এ কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রিন্সিপাল— দেখুন, আপনাকে আমি সবটাই বোঝানোর চেষ্টা করলাম। আপনি শুনলেন না। এরপরে যা কিছু হবে তার জন্য আপনি দায়ী থাকবেন।
পরদিন স্কুল কম্পাউন্ডে…
স্কুলের গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বাইরে থেকে। চলছে তুমুল বিক্ষোভ। ধর্না, স্লোগান। উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার জন্য মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। “অযোগ্য শিক্ষক দিয়ে স্কুল চালানো চলবে না’’, “শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক নৈরাজ্যর প্রতিবাদে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন”, “অঙ্ক শিক্ষক বিপ্রদীপ নিপাত যাও “, “শিশুমন বিকাশের বিরোধী শিক্ষক বিপ্রদীপকে অবিলম্বে স্কুল থেকে বিতাড়িত করতে হবে”— ঘন ঘন অভিভাবকদের স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠল স্কুল কম্পাউন্ড।
দারোয়ান দৌড়ে এলো বিপ্রদীপের কাছে— আপনি স্কুল কম্পাউন্ডের বাইরে যাবেন না।
বিপ্র— কেন কি হয়েছে?
দারোয়ান— আপনার বিরুদ্ধে সমস্ত গার্জিয়ানরা এক হয়ে স্লোগান দিচ্ছে।
বিপ্র— কেন আমি কি করলাম?
দারোয়ান— সেটা আমি কি করে বলবো? তবে যা বুঝলাম ওরা বলছে আপনি নাকি অঙ্ক পারেন না। জোর করে একজন ছাত্রকে শূন্য দিয়েছেন। আমি আপনাকে ডাকতে এসেছি। কারণ, স্কুল কমিটির মিটিং হচ্ছে আপনাকে নিয়ে, ওখানে আপনাকে ডাকছে।
স্কুল কমিটির মিটিং। উপস্থিত কমিটির সব সদস্য।
—কি হল হঠাৎ করে মিটিং ডাকতে হল কেন?
স্কুল কমিটির সেক্রেটারি— আমাকে মার্জনা করবেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে মিটিংটা ডাকতে হল। আপনাদের মূল্যবান সময় কিছু নষ্ট হল। কিন্তু বিষয়টা এতো গুরুতর যে আপনাদের ডাকতে বাধ্য হলাম। সবাই চা খেয়েছেন তো?
এক সদস্য— না, তা আর খেলাম কোথায়! তুমি দারোয়ানকে ডেকে চা দিতে বলো।
সেক্রেটারি দারোয়ানকে ডাকলেন। চায়ের ব্যবস্থা করতে বললেন।
দারোয়ান— তা আপনারা এখন কি চা খাবেন?
সেক্রেটারি— কি চা খাবেন মানে? লিকার বা দুধ দেখে নাও।
দারোয়ান— না, বাবুরা আগে লাল চা খেত, এখন গ্রিন টি খায়, কেউ কেউ আবার ওই গ্রিনটির মধ্যে একটু দুধ ফেলে অন্যরকম চা চাইছে। তাই জিজ্ঞাসা করছিলাম আর কি।
—ঠিক আছে তুমি তিন রকমই নিয়ে এসো।
দারোয়ান চলে গেল।
এক সদস্য—হ্যাঁ, কি ব্যাপার? বিষয়টা একটু খুলে বল তো!
সেক্রেটারি— আর বলবেন না। স্কুলটা প্রায় উঠে যাবার জোগাড়। ঘটনাটা হল, বিপ্রদীপ সরকার বলে এক শিক্ষক, বিধায়ক মশাইয়ের ছেলেকে অঙ্কে শূন্য নম্বর দিয়ে দিয়েছে।
সদস্য— সেকি। এতবড় সাহস? এই সাহস ও পেল কোথা থেকে? খোঁজ নিয়েছেন, কোনও বিরোধী শক্তি ওকে ব্যাক করছে কিনা? উনি আবার ওই সব সহিংস প্রকৃতির নন তো?
সেক্রেটারি— আরে না! একেবারে নেতানো গোবেচারা মানুষ।
সদস্য— তবে এত সাহস পেল কি করে?
সেক্রেটারি— উনি একটু সেকেলে মানুষ। জানেন তো এইসব লোক কেমন হয়। বিধায়কের ছেলে ২ আর ২ বাইশ লিখেছে, তাই উনি নম্বর দেননি। গোয়ার্তুমি করে বসে আছে ২ আর ২ চার লিখতে হবে।
সদস্য— ও এই ব্যাপার । ডাকুন ওকে আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি ২ আর ২ এ ক কী ভাবে বাইশ লিখতে হয়।
চেয়ারম্যান— সেক্রেটারি, বিপ্রবাবুকে ভেতরে আসতে বল।
বিপ্রদীপ ঘরে প্রবেশ করলেন।
চেয়ারম্যান— আপনি বিধায়কের ছেলেকে অঙ্কে শূন্য দিয়েছেন?
বিপ্রদীপ— না, মানে স্যার ও যোগটা ঠিক করতে পারে না। ওর যোগ করায় একটু প্রবলেম আছে।
চেয়ারম্যান— কী রকম প্রবলেম?
বিপ্রদীপ— ও ২ আর ২ এর যোগ করতে পারেনি। বাইশ লিখেছে।
চেয়ারম্যান— কি লিখলে ঠিক হতো বলে মনে হয়?
বিপ্রদীপ— মানে?
চেয়ারম্যান (রাগত কন্ঠে)— কি লিখলে ঠিক হতো বলে আপনার মনে হয়?
বিপ্রদীপ আমতা আমতা করে— চার স্যার!
সদস্য— হল না! টু প্লাস টু ফোর অনলি ফর পুওর।
বিপ্রদীপ (ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে) — মানে!
সদস্য— আরও শুনে নিন, দুই আর দুই বাইশ যাদের জন্য কামানো যায় টু পাইস।
চেয়ারম্যান— আপনি খুব অঙ্কের বড়াই করেন না! আচ্ছা, দ্বিঘাত সমীকরণ জানেন?
বিপ্রদীপ— দ্বিঘাত সমীকরণ?
চেয়ারম্যান— হ্যাঁ, দ্বিঘাত সমীকরণ। দেখবেন, যে কোনও দ্বিঘাত সমীকরণে এক্সের দুটো মান বের হয়। যারা জানে কী ভাবে দুই আর দুই বাইশ করতে হয়, তাদের জন্য একটা মান। আর যারা নিজেদের পরিবর্তন করতে পারেন না, তাদের জন্য দুই আর দুই চিরকাল চার থেকে যায়।
বিপ্রদীপ— কি বলছেন স্যার? আমি তো জানতাম অঙ্ক চির সত্য তার কোনও পরিবর্তন নেই। সে তার আপন নিয়মে চলে।
চেয়ারম্যান— থামুন মশাই! আমরা ইতিহাসকে বিকৃত করতে পারি। ভূগোলের ম্যাপ নিজেদের মতো তৈরি করতে পারি, যে কোনও ইকুয়েশন, এমনকি লাইফ সাইকেল বদলে দিতে পারি আর সামান্য দুই আর দুই বাইশ করতে পারবো না! যান, ওই ছাত্রের কাছে যান আর ওর বাবা-মার কাছে ক্ষমা চান। ওকে ফুল মার্ক্সটা দিয়ে দিন।
বিপ্রদীপ— আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। আমি এটা পারবো না। আমার এতদিনের শিক্ষার সাথে আপস করতে পারব না।
সদস্য— তবে আগামিকালের স্কুল মাইনাস আপনি। এটাই আপনার ভবিতব্য।
চেয়ারম্যান— সেক্রেটারি, উনি তো আমার কথা শুনলেন না। ওকে স্কুলের বাইরের দরজাটা দেখিয়ে দাও।
এদিকে গেটে চলছে প্রতিবাদ সভা। মিটিং সেরে বেরিয়ে এলেন স্কুল কমিটির সেক্রেটারি।
—শুনুন, আপনারা শুনুন, আপনাদের সেন্টিমেন্ট আমি বুঝতে পারছি। আর পারছি বলেই আজ আমাদের স্কুলকমিটি একটি জরুরি মিটিং করেছে। আপনাদের দাবি মতো আমরা বিপ্রদীপ সরকারকে এই মূহূর্ত থেকে বরখাস্ত করেছি। আর একটা বিশেষ আনন্দের খবর আপনাদের দিতে চাই, এই শিশুটি— যে আমাদের স্কুলকে গর্বিত করেছে, যে প্রমাণ করেছে দুই আর দুই বাইশ হয়, তাকে আমরা সম্বর্ধিত করবো। আগামী শনিবার এই স্কুলের সভাগৃহে সেই অনুষ্ঠান হবে। আপনাদের সবার আমন্ত্রণ রইলো।
বিপ্রদীপ স্কুল থেকে বিতাড়িত হলেন।
সারা সমাজ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল— ২ আর ২ চার না বাইশ? বিজ্ঞজনেরা বসে পড়লেন বিশ্লেষণে – আরে! এতো এক নতুন দিগন্ত! আবার কিছু লোক বিপক্ষেও বললেন। কিন্তু সেই কণ্ঠ খুবই দুর্বল। যদি দুই যোগ দুই বাইশ হয়, তবে তো পুরো সিস্টেমটাই পাল্টে যাবে। উভয় পক্ষে জনমত গড়ে উঠল। তুমুল বিতর্ক দুই আর দুই এ বাইশ না চার।
নিজের ঘরে সোফায় বসে আছেন বিপ্রদীপ আর তাঁর স্ত্রী মাধবী।
—কি হচ্ছে এসব? যে অঙ্ক চিরকালীন, তাকেও বদলে দেবে ওরা?
মাধবী— কেন? তুমি জানো না অঙ্ককেও বদলানো যায়। ৫১ যখন ৪৯-এর ঘরে চেপে বসে, তখন রাজার থেকেও শক্তিশালী হয়ে ওঠে মন্ত্রী, তাদের অধিকার জন্মে যায় যা ইচ্ছে তাই করার। কারণ, জনগণ তার সাথে।
বিপ্র— তা বলে যা ইচ্ছে তাই করবে?
মাধবী— করছে না! আকবর মেবারের যুদ্ধে হারছে না? রবীন্দ্রনাথ অপ্রাসঙ্গিক হচ্ছে না? আয়ের বৈষম্য সত্ত্বেও চতুর জিডিপির অঙ্কে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে না? সেই খেলায় কারও সম্পত্তি ১০০ গুণ বাড়ছে আর কেঊ সর্বস্ব হারাচ্ছে।
বিপ্র— কিন্তু এর থেকে বের হবার কি কোনও উপায় নেই?
মাধবী— ক্ষমতার স্তম্ভগুলি জানবে দেখতে খুব শক্তিশালী কিন্তু ভেতর থেকে খুব দুর্বল। যারা এই ক্ষমতাকে হাতের মুঠোয় রাখতে চায়, জানবে তাদের সবটাই চাটুকারিতা আর লিপ্সায় মোড়া। ভেতরে ভেতরে এরা খুবই দুর্বল। তোমাকে আঘাতটা ওখানেই করতে হবে। দেখবে তখন ওরা আবার ২ আর ২ চার বলতে শুরু করেছে। তোমার কাজ হল, শুধু সেই জায়গাটা খুঁজে বের করা। অনেক রাত হয়েছে। এবার তুমি ভাবো, আমি গেলাম।
পরদিন বিপ্রদীপ ফোন করলেন স্কুলের প্রিন্সিপালকে।
প্রিন্সিপাল – হ্যালো
বিপ্র— আপনি প্রিন্সিপাল বলছেন? আমি বিপ্রদীপ আপনাদের স্কুলের সদ্য প্রাক্তন হওয়া অঙ্কের টিচার।
প্রিন্সিপাল— ও হ্যাঁ, বলুন কি ব্যাপার?
বিপ্র— স্যার, আমার তো কিছু পাওনা ছিল। কিছু টাকা তো আমি স্কুল থেকে পাবো। আমার শেষ দু’মাসের মাইনে বাকি আছে স্যার।
প্রিন্সিপাল— ও হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনার দু’মাসের মাইনে বাকি তাই না! আপনি এক কাজ করুন, শনিবার চলে আসুন। সেই দিন একটা সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান আছে, ওখানে আপনাকে টাকাটা দিয়ে দেবো।
বিপ্র— ঠিক আছে স্যার, ঠিক আছে।
শনিবার…
স্কুলের সভাগৃহটিকে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। উপস্থিত সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। পুরো অনুষ্ঠানটাই লাইভ টেলিকাস্ট করা হবে। সব কিছুই হয়েছে বিধায়কের বদান্যতায়। বিধায়কের ছেলে আজ সম্বর্ধিত হবে অঙ্কের পরিবর্তিত রূপ আবিষ্কারের জন্য। মঞ্চে উপস্থিত বিধায়ক মহাশয় বিদ্যাসূদন দত্ত আর তাঁর সহধর্মিনী রত্নজায়া দত্ত। আছেন স্কুলের চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারি। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন প্রিন্সিপাল নিজে।
প্রিন্সিপাল— আজ আমাদের বড় আনন্দের দিন। আমরা আজ নিজেদের গর্বিত মনে করছি। একদিন আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারবো— সেই যুগমানব আমাদের স্কুলে পড়তো যে অঙ্কের পরিবর্তিত রূপ আবিষ্কার করেন। আমরা ধন্য। এখানে উপস্থিত রয়েছেন মন্ত্রী বিদ্যাসুদন দত্ত। আর উপস্থিত আছেন সেই মা, যিনি জন্ম দিয়েছেন এমন এক সন্তানকে যে আমাদের গর্ব। আমরা একটু পরেই ডেকে নেব তাকে। তার আগে আমি একটু ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। মানে, কারণ ছাড়া যেমন কার্য হয় না, তেমনি বস্তাপচা ধ্যানধারণা নিয়ে চলা বিপ্রদীপ সরকার না থাকলে রত্নবিজয় অঙ্কের পরিবর্তিত রূপের জন্মদাতা হয় না। তাই আমরা বিপ্রদীপ সরকারকে আজ এখানে ডেকে এনেছি। মঞ্চে উঠে আসুন বিপ্রদীপবাবু।
বিপ্রদীপ মঞ্চে উঠে এলেন।
প্রিন্সিপাল— বিপ্রদীপবাবু, আপনি জানেন কেন আপনাকে এখানে ডাকা হয়েছে?
বিপ্র—কেন?
প্রিন্সিপাল— এক নতুন সূর্য উঠবে বলে। আপনি দেখবেন, আপনাদের মতো কালো অমাবস্যা থেকে কেমন আলোর উজ্জ্বল রশ্মি হয়ে ফুটে উঠবে রত্নবিজয় । আপনার কিছু বলার আছে আজকের এই দিনটা নিয়ে?
বিপ্র—আজ্ঞে স্যার, আমার তো কিছু বলার নেই। আমি এসেছি আমার দু’মাসের মাইনে নিয়ে ফিরে যেতে। ওটা বুঝিয়ে দিন, চলে যাই।
প্রিন্সিপাল— ও, হ্যাঁ। সবাই দেখুন, আমাদের স্কুল কত মহান। উনি এত বড় অন্যায় করার পরেও আমরা ওর টাকা আটকে রাখবো না। এখনি আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব ওর হাতে গতমাসের কুড়ি হাজার টাকা আর এই মাসের কুড়ি হাজার টাকা মিলিয়ে মোট চল্লি¬শ হাজার টাকা তুলে দেবেন।
বিপ্র— আমাকে একটু মাইকটা দেবেন?
প্রিন্সিপাল— আপনি বলবেন? ঠিক আছে বলুন। কিন্তু দু’মিনিট। অনেক ঠাসা অনুষ্ঠান আছে আজ। আপনি একটু সংক্ষেপে বলবেন। ঠিক আছে?
বিপ্রদীপ— না না স্যার, আমি বেশি সময় নেবো না। আমি আজ শুধু আমার পাওনাটাই বুঝে নিতে এসেছি। বলছি কি স্যার, আপনার অঙ্কে কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি আমাকে গতমাসের ২০০০০ আর এই মাসের ২০০০০ মিলিয়ে মোট ২০০০০২০০০০ টাকা দেবেন স্যার, ৪০ হাজার নয়।
প্রিন্সিপাল— মানে?
বিপ্রদীপ— অঙ্কের পরিবর্তিত রূপ স্যার। ২ আর ২ যোগ দিলে ২২।
অলংকরণ-রাতুল চন্দরায় ও সার্থক দাস
—————————————————————————-
অনিন্দ্যর গল্পটা পড়লাম। মনে হয় আগে একবার আমাকে শুনিয়েছিল, মনে পড়ছে না। ভালো স্যাটায়ার, বর্তমান সময়ের একটা দিক ভালোভাবে ধরা গেছে। তবে শেষটায় তাড়াহুড়ো আছে, সেক্সপীয়ার হ্যান্ডল করা বেশ ঝামেলার।