প্রথম বিশ্বকাপের পরেই বোঝা গিয়েছিল— এই টুর্নামেন্টের দম আছে। ফুটবল বিশ্বকাপ জনপ্রিয়তা অর্জন করবে। প্রাথমিক পর্যায়ে অংশগ্রহণ করলো ৩৬টি দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বকাপ থেকেই শুরু হয় কোয়ালিফিকেশন রাউন্ড। ৩৬টির মধ্যে ১৬টি দেশ মূলপর্বের যোগ্যতা অর্জন করল। এটিই কিন্তু একমাত্র বিশ্বকাপ, যেখানে আয়োজক দেশকেও কোয়ালিফাই করতে হয়েছিল। তবে সেই রাউন্ডের খেলাটি নিয়ে অনেক বিতর্ক লুকিয়ে রয়েছে। কোয়ালিফিকেশন রাউন্ডে ইতালির খেলার কথা গ্রিসের সঙ্গে। প্রথম লিগে ইতালি নিজেদের মাটিতে গ্রিসকে ৪-০ গোলে হারিয়ে দেয়। তারপর খেলা গ্রিসের মাঠে। খেলা দেখতে ২০হাজার টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছে। ভীষণ উত্তেজনা গোটা গ্রিস জুড়ে। সেইসময় এক অজানা কারণে গ্রিস নিজের দেশের মাটিতে ইতালির বিরুদ্ধে খেলা থেকে নাম উইথড্র করে। ফিফার অফিশিয়াল রেকর্ড বলছে, গ্রিস লজ্জাজনক পরাজয়ের থেকে বাঁচার জন্য নাম তুলে নিয়েছিল। তবে পরবর্তী কালে International Federation of Football History and Statistics (IFFHS) তাদের একটি রিপোর্টে বলেছে, পুরোটাই ছিল টাকার খেলা। ইতালির ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন আজকের মুদ্রায় প্রায় ৪০০০০০ ডলার দিয়ে গ্রিসের রাজধানী এথেন্স-এ একটি বাড়ি কিনে দিয়েছিল গ্রিস ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে। মুসোলিনির একটা ছায়া ছিল এই পুরো ঘটনায়। যাই হোক, এদিকে উরুগুয়ে নাম প্রত্যাহার করলো, সেই সঙ্গে পেরু এবং চিলি। কেন তারা অংশগ্রহণ করবে না? কারণ, ১৯৩০ সালে ইউরোপ থেকে ফুটবল প্র্রধান দেশগুলির উরুগুয়েতে না যাবার কারণে এই সিদ্ধান্ত। আর্জেন্টিনাও প্রাথমিক ভাবে না করে দিয়েছিল, কিন্তু পরে তারা একটি অপেশাদার টিম পাঠিয়ে দেয়। আর ব্রিটেন বিশ্বকাপ খেলবে না জানিয়ে বললো, তাদের ফুটবলাররা সেই সময়ে ঘরোয়া খেলায় ব্যস্ত থাকবে। ইউরোপ থেকে যোগ্যতা অর্জন করেছিল ১২টি দেশ— অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চেকোশ্লভাকিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, রোমানিয়া, স্পেন, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড। লাতিন আমেরিকা থেকে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। উত্তর আমেরিকা থেকে ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা। আর ছিল ইজিপ্ট। এই দেশটি কিছুটা এশিয়ায় বেশির ভাগটা আফ্রিকাতে। সব মিলিয়ে এই ১৬টি দেশ।
সেই সময় ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট সরকার। বিশ্বকাপ খেলা হবে আর বিতর্ক থাকবে না! বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এল একটি নৈশভোজ। ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী দলগুলির একটি অস্ট্রিয়া। সেই অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ইতালির খেলার আগের দিন রাতে মুসোলিনি নৈশভোজ করলেন অস্ট্রিয়া ও ইতালির ম্যাচ রেফারি সুইডেনের ইভান একলাইন্ড (Ivan Eklind)-এর সঙ্গে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, সেই খেলায় বিশেষ কিছু মুহূর্তে রেফারি ইতালির পক্ষ নিয়েছিল। এখানেই শেষ নয়। ফাইনালে নির্বাচিত রেফারি ছিলেন বেলজিয়ামের, ২৪ ঘণ্টা আগে তাঁকে সরিয়ে রেফারি করা হয় একলাইন্ডকে। শোনা যায়, ফাইনালেও বেশ কিছু পক্ষপাতিত্বের সুবিধা পেয়েছিল ইতালি।
ইতালির মোট আটটি শহরে, আটটি স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের মূল খেলাগুলি হয়। ফাইনাল হয়েছিল রোমের Stadio Nazionale PNF স্টেডিয়ামে। এখানে PNF মানে -Partito Nazionale Fascista (জাতীয় ফ্যাসিস্ট পার্টি)। হাঙ্গেরি আর অস্ট্রিয়ার খেলার সময় হয়েছিল এক বিভ্রাট। অস্ট্রিয়ার কাছে হারের পরে হাঙ্গেরির প্লেয়াররা রেফারিকে ঘিরে ধরে মারতে থাকেন। বিশ্বকাপের কলঙ্কজনক ঘটনাগুলির মধ্যে এটির উল্লেখ থাকে। কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেন ও ইতালির খেলা ছিল যেমন উচ্চমানের, তেমনি প্রচন্ড মারপিটও হয়। প্রথম দিনের খেলা ড্র হয়। দ্বিতীয় দিন (তখন পেনাল্টি শুট আউট ছিল না। ১৯৭৮ সালে পেনাল্টি শুট আউট-এর মাধ্যমে খেলার নিষ্পত্তির নিয়ম আনা হয়) স্পেন তার প্রথম গোলকিপার জামোরা (Zamora) কে মাঠে নামাতে পারেনি। কারণ, ইতালির ফুটবলাররা তাঁকে প্রথম দিনেই মাঠে নির্মম ভাবে মেরেছিল। দ্বিতীয় দিনের খেলায় ইতালি জিতে যায়।
১৯৩০ সালে খেলার কম্বিনেশন ছিল ২-৩-৫। মানে দুজন ডিফেন্স, মিডফিল্ডে তিনজন আর পাঁচজন স্ট্রাইকার। ১৯৩৪ সালে ইতালিয়ান কোচ ভিত্তোরিও পোজো নিয়ে এলেন ২-৩-২-৩ সিস্টেম। এই সিস্টেমকে বলা হয় W-M বা matodo সিস্টেম। আর এই সিস্টেম দিয়ে বিশ্ব জয় করলো ইতালি।
১৯৩৪ সালের ফাইনাল হয়েছিল ইতালি ও চেকোশ্লভাকিয়ার মধ্যে। রেফারি ইভান একলাইন্ড। প্রথমে গোল দিয়ে এগিয়ে যায় চেকোশ্লভাকিয়া। খেলার অন্তিম লগ্নে গোল শোধ করে ইতালি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফলাফল ছিল ১-১। কিন্তু রেফারি নির্ধারিত সময়ের থেকে প্রায় ৫ মিনিট বেশি খেলান। আর সেই পাঁচ মিনিটের মাথায় গোল দেয় ইতালি। ২-১ গোলে নির্ধারিত হয় জয়-পরাজয়। ইতালি নিয়ে যায় ১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপ। স্বপ্ন সার্থক হয় মুসোলিনির।