১৯৮০ সাল। সে বছর মহামেডান টিম করেছিলেন হাজি মাস্তান। ময়দানে এসে তিনি তুলে নিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গলের প্রায় সব বড় প্লেয়ারকে। লাল-হলুদ শিবির থেকে চলে গিয়েছিলেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত , প্রশান্ত ব্যানার্জি , ভাস্কর গাঙ্গুলি, সাব্বির আলি, চিন্ময় চ্যাটার্জী, শ্যামল ঘোষ , ডেভিড উইলিয়াম-সহ ন’জন খেলোয়াড়। সিঙ্গাপুরের ‘সী লায়ন’ হোটেলে চুক্তি সম্পূর্ণ খেলোয়াড়দের সঙ্গে। শিড়দাঁড়া ভেঙে গিয়েছে ইস্টবেঙ্গল টিমের। কোটি কোটি সমর্থক ছটফট করছেন আর ভাবছেন— কী করে তৈরি হবে টিম। ভরসা করা যায় এমন প্লেয়ারদের মধ্যে শুধু রয়ে গিয়েছেন মনোরঞ্জন আর সত্যজিৎ মিত্র। ১৯৮০ সালের ময়দান আজকের ময়দানের থেকে অনেক আলাদা। হাজার হাজার সমর্থক প্রতিদিন আসছেন ক্লাব তাঁবুতে। জানতে চাইছেন, কী করছেন ক্লাব কর্তারা? মনের ভিতরে উদ্বেগ, টিম কি একদম ডুবে যাবে ?
এই সময়েই শোনা গেল, ইরান থেকে এসেছেন তিনজন খেলোয়াড়। আর ভিন্ রাজ্য থেকে প্রেমনাথ ফিলিপ আর স্ট্রাইকার সিবি থাপা। সবে মাত্র সই হয়েছে। মোহনবাগান থেকে কোচ করে আনা হয়েছে প্রদীপ ব্যানার্জিকে। সমর্থকরা ভিড় করে এসেছেন ক্লাবের অনুশীলন দেখতে। আরে, ওটা কে? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সামারসল্ট দিচ্ছে! কী দারুন দেখতে! কী গায়ের রং! ঠিক যেন রাজপুত্র! বেশি লম্বা নয়। কিন্তু গাট্টাগোট্টা। একটা গুঞ্জন শুরু হল সমর্থকদের মধ্যে— কে এই ছেলেটি ? জানা গেল, ওঁর নাম মজিদ। মজিদ বাসকার। ইরানের জাতীয় টিমের প্লেয়ার। ১৯৭৮-এ ইরান বিশ্বকাপ টিমেও ছিল। দারুণ প্লেয়ার! প্রথমদিন প্রাকটিস দেখে একটু একটু করে আশায় বুক বাধতে শুরু করলেন ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরা।
কলকাতা লীগে সে বছর ইস্টবেঙ্গলের প্রথম খেলা ছিল বেহালা ইউথের সঙ্গে। খেলা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই বেহালা ইউথ বল ঢুকিয়ে দিল ইস্টবেঙ্গলের গোলে। লাল-হলুদের গোলকিপার বিশ্বজিৎ দাস। নিরীহ একটি শটে গোল খেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু মজিদ কী করেছে ? কেমন যেন দুলকি চালে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঠে। প্রথমার্ধের শেষ দিকে সাইড ব্যাক থেকে উঠে এসে প্রেমনাথ গোল শোধ করলেন ইস্টবেঙ্গলের হয়ে। ফলাফল ১-১। প্রথমার্ধে মজিদের খেলা দেখে দর্শক চুড়ান্ত হতাশ। শুরু হল দ্বিতীয়ার্ধের খেলা। একটু নেমে নিজের হাফ থেকে বল নিতে শুরু করলেন মজিদ। পুরো দ্বিতীয়ার্ধে খুঁজেই পাওয়া গেল না বেহালা ইউথকে। ৫ গোল দিল ইস্টবেঙ্গল। মজিদ একটা আর সিবি থাপা চারটে, তার সবক’টি পাশই এসেছে মজিদের পা থেকে। ৬-১ গোলে জিতল ইস্টবেঙ্গল। ততক্ষণে দর্শকদের চোখ কপালে উঠেছে! এ-কী শিল্পের বিস্ফোরণ দেখলেন তাঁরা! প্রথমদিনেই মজিদ হয়ে উঠলেন দর্শকের নয়নের মনি। নতুন করে আশায় বুক বাধতে শুরু করলেন ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকরা।
ভারতের ক্লাবগুলির হয়ে খেলে গিয়েছেন বহু বিদেশি প্লেয়ার। ইয়াকুব, রন্টি মার্টিন, জুনিয়র, এমেকা, চিমা, জ্যাকসন— তারপর মোহনবাগানের ঘরের ছেলে ব্যারেটো। আর এখন তো প্রতিটি ক্লাবে দেশি থেকে বিদেশি খেলোয়াড়ের সংখ্যা বেশি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সবকিছুর পরেও মজিদ বাসকার হলেন কলকাতা ফুটবলের বাদশা। খেলার মাঠে যেমন তাঁর বাদশাহী আচরণ। তেমনটা মাঠের বাইরেও! মজিদ একেবারে দর্শকের নয়নের মনি।
কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন ভারতের স্বনামধন্য ফুটবলার, সুভাষ ভৌমিক। দেখে নেওয়া যাক্, মজিদকে নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ— ‘‘আমি ১৯৭৯ সালে ক্লাবের (ইস্টবেঙ্গল) উপর বিরক্ত হয়ে খেলা থেকে অবসর নিয়েছিলাম। প্রদীপদা আমাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কথা শুনিনি। আমি খেলা ছাড়লাম আর তারপর সুরজিৎ-সহ একঝাঁক ফুটবলার বেরিয়ে গেল ক্লাব থেকে। শুনলাম, ক্লাব তিনজন ইরানিয়ান ফুটবলারকে সই করিয়েছে। মজিদ বাসকার, জামশিদ নাসিরি ও মহম্মদ খাবাজি। ওঁরা পড়াশুনা করতে এসেছিল আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুনলাম, ওঁদের মধ্যে মজিদ ছেলেটি নাকি অসাধারণ প্লেয়ার। ইচ্ছে হল ওঁর খেলা দেখার। মজিদ বাসকারকে দেখে বুঝতে পারলাম, আমার ফুটবল ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে কতটা বোকামি ছিল। ওঁর নির্ভুল পাসিং, মাঝমাঠ থেকে খেলা তৈরি আর একটা পাসে পুরো ডিফেন্সকে চিড়ে ফেলার ক্ষমতা দেখে অবাক হয়েছিলাম। আফসোস হল, যদি থাকতে পারতাম মজিদের আশপাশে— তা হলে আমি হয়তো নায়ার-দা-এর রেকর্ডটা (ইস্ট বেঙ্গলের স্বামী নায়ার: ৩৬ গোল, ১৯৪৬ কলকাতা লীগ) ভেঙে দিতে পারতাম। তবে ভাল লেগেছিল, আমার ছেড়ে যাওয়া ১২ নম্বর জার্সিটা মজিদকে পরতে দেখে।’’
নর্থ জোন ইন্টার ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়নশিপে মজিদের খেলা দেখে লাল-হলুদ কর্মকর্তারা তাঁকে নিয়ে আসেন ইস্টবেঙ্গলে। ১৯৮০ সালে ময়দানে এসে মজিদ দু’টি সর্বভারতীয় ট্রফি এনে দিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গলকে। ফেডারেশন কাপ আর রোভার্স কাপ। তারপর ১৯৮১ সালে জিতলেন আইএফএ শিল্ড ও দার্জিলিং গোল্ড কাপ। ভারতে মজিদ বোধহয় জীবনের সেরা খেলাটা খেলেছিলেন দার্জিলিং গোল্ড কাপে মোহনবাগানের বিপক্ষে। ৭৬ মিনিট হয়ে গিয়েছে। ইস্টবেঙ্গল হারছে ২-০ গোলে। সমর্থকরা হতাশ হয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। শুরু হল মজিদ-ম্যাজিক। হাবিবের সাথে ওয়ান-টু পাশ খেলে বল দিলেন জামশিদকে। ২-১। ঘুরে গেল খেলা। মাঠে ফুল ফোটালেন মজিদ। এক সময়ে মোহনবাগানের পর পর ছ’জন প্লেয়ারকে কাটিয়ে পৌঁছে গেলেন গোলকিপারের সামনে। প্লেস করলেন বলটি কিন্তু একটুর জন্য বাইরে চলে গেল। কিন্তু তা-ও আটকানো গেল না ইস্টবেঙ্গলকে। ৩-২ গোলে জিতল ইস্টবেঙ্গল। সুব্রত ভট্টাচার্য খেলার শেষে বললেন — ‘‘মজিদ হলেন আমার দেখা সেরা খেলোয়াড়।’’
১৯৮২ সালে মজিদ ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে চলে যান মহামেডানে। ১৯৮৭ পর্যন্ত সেখানে খেললেন তিনি। জিতলেন আরও কিছু ট্রফি। আর সেই সঙ্গে শুরু হল বোহেমিয়ান জীবন। নারী,সূরা ড্রাগ প্রবেশ করল তাঁর জীবনে। ময়দান থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলেন মজিদ।
মজিদ বাসকার। না, আসল নাম মজিদ বাসকার নয়—বিসকার (Majid Biskar)। আমাদের উচ্চারণের কারণে হয়ে গিয়েছিলেন বাসকার। কলকাতা মাঠে অনেক বিদেশি ফুটবলার এসেছেন, অনেকদিন রাজত্বও করেছেন। কিন্তু মাত্র কয়েকবছর খেলে কলকাতার ফুটবল দর্শকদের যে আনন্দ মজিদ বাসকার দিয়েছেন ,তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কলকাতার ফুটবল অনুগামীরা এখনও মনে করেন— বাদশা একজনই হতে পারে — আর তিনি মজিদ ছাড়া আর কেউ নন।