শুভেন্দু রায় চৌধুরী

একটা উঁচু বেদির উপর শোয়ানো রয়েছে তাঁর নিথর দেহ। ভেজা চোখে অসংখ্য গুণমুদ্ধ ভক্ত জানিয়ে যাচ্ছেন শেষ শ্রদ্ধা। সেই প্রবল ভিড়ের মধ্যেও সুযোগ পেয়েছিলাম তাঁকে শেষবারের মত প্রণাম জানানোর। নীরবে গিয়ে দাঁড়ালাম শায়িত দেহটির পাশে। ধবধবে সাদা চাদরের তলায় তাঁর পায়ের ইঙ্গিত বেশ স্পষ্ট। সেই দু’টি পা— যা বারবার বোকা বানিয়েছে প্রতিপক্ষের বাঘা বাঘা ডিফেন্ডারকে। সেই পায়ের জাদুতে মুদ্ধ ছিল কলকাতা ময়দানের সব ফুটবলপ্রেমী। তাঁর খেলা দেখার মুগ্ধতা কখনওই ফিকে হবার নয়।

মনে পড়ল ৭৯-এর আইএফএ শিল্ড সেমিফাইনালে বিদেশি দলের বিরুদ্ধে জিরো ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল থেকে করা গোলটার কথা। যা দেখে প্রতিপক্ষের ফুটবলারেরা পর্যন্ত হাততালি দিয়ে উঠেছিলেন। সেটাও আবার এমন এক সময়ে যখন মাঠের বাইরে তাঁকে এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের কোণঠাসা করার চেষ্টা চলছে।

৭৯ সালের আইএফএ শিল্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা। অথচ ক্লাবে ঠিক মতো প্র্যাকটিসই হচ্ছে না। তাই নিজের উদ্যোগেই ওই ম্যাচের কয়েকদিন আগে থেকেই সুরজিৎ সেনগুপ্ত প্র্যাকটিস করছিলেন স্যার দুঃখীরাম কোচিং সেন্টারে গুরু অচ্যুৎ ব্যানার্জির কাছে। সোয়ার্ভিং শট মারার বিষয়ে সাহস যুগিয়েছিলেন অত্যুৎ ব্যানার্জিই। প্র্যাকটিসে অমন শট মারতে দেখে বলেছিলেন, ‘পারিস তো মারিস না কেন,’ —সেই গুরুমন্ত্রেই সেদিন ময়দানের সবুজ ঘাসে দেখা গিয়েছিল এক ঝলক শিল্প।

এমনটাই ছিলেন চুঁচুড়ার বিশু ওরফে সুরজিৎ সেনগুপ্ত। সমরেশ চৌধুরীর মতো তাঁকেও বারবার কর্মকর্তাদের অবিচারের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু কোনওদিনই তাঁকে বশ মানতে দেখিনি। সত্তরের দশকে খেলার মাঠে ফুটবলারদের লড়াইয়ের শেষ কথা যদি হয় হাবিব, তবে মাঠের বাইরে ফুটবলারদের লড়াইয়ে সবসময়েই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুরজিৎ। অথচ ব্যক্তিগত জীবনে গুরুজনদের কথা অমান্য করা মতো বদভ্যাস তাঁর ছিল না। একটা উদাহরণ দিই। পরপর কয়েকদিন ট্রেন লেট করায় প্রাকটিসে আসতে দেরি হয়েছিল তাঁর। রোজ সেই একই অজুহাত শুনে রেগে গিয়েছিলেন মোহনবাগানের তৎকালীন কোচ অরুণ সিন্হা। সবার সামনেই তাঁকে বলেছিলেন, ‘স্টপ দিস মাংকি বিজনেস। কাল থেকে আগের ট্রেনে আসবে।’ এরপর থেকে সুরজিৎ জীবনে দ্বিতীয় কোনওদিন কোনও কোচকেই এমন কথা বলার সুযোগ দেননি।

নিজের চাহিদা সম্পর্কে মুখ ফুটে কিছু বলতেও সুরজিতের ছিল তীব্র অনীহা। ব্যাপারটা ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়েছিল। ছোটবেলাতে স্কুলের দলে খেলার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু জানতেন, বুট পায়ে দিয়ে নামতে না পারলে খেলায় সুযোগ পাবেন না। তা সত্ত্বেও বুট কিনে দেওয়ার জন্য বাবাকে একবারের জন্য বিরক্ত করেনি ছোট্ট ছেলেটি। শেষপর্যন্ত সুরজিতের একজন মাষ্টারমশাই তাঁর বাবাকে রাস্তায় দেখে বলেছিলেন ছেলেকে বুট কিনে দিতে। সেটাই ছিল তার জীবনের প্রথম পাওয়া ফুটবল বুট। তাই সেই সুরজিতের বিরুদ্ধে কলকাতা ময়দানে তারকাসুলভ মনোভাবের অভিযোগ কখনওই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে কথাটা রটেছিল। আর সে সব নিশ্চিত ভাবেই তাঁদের রটনা, যাঁরা সুরজিৎকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েও পারেননি। মাঠ আর মাঠের বাইরের এই সমস্ত প্রতিপক্ষকে অনায়াসেই টপকে গিয়েছিলেন কলকাতা ময়দানের সত্যিকারের তারকা সুরজিৎ সেনগুপ্ত।

ফুটবল প্রতিভাকে দিয়ে ময়দানের কর্মকর্তাদের যাবতীয় অপমানের জবাব সুরজিৎ দিয়েছিলেন অবসর নেওয়ার পরেও। অবসর নেওয়ার বেশ কয়েক বছর পর সুরজিৎ আবার প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে ফিরিয়ে এসেছিলেন দাদা, বন্ধু সুভাষ ভৌমিক। সুভাষ তখন জর্জ টেলিগ্রাফের কোচ। নিজের দলের আক্রমণভাগের শক্তি বৃদ্ধি করতে তিনি সুরজিৎ সেনগুপ্তকে নতুন করে ফুটবলে ফেরানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। রাজিও করিয়েছিলেন সুরজিৎকে। ৭৫ সালে এই সুভাষই ফর্ম হারিয়ে ফেলা সুরজিৎকে একবার ময়দান থেকে সরিয়ে দিন সাতেকের জন্য নিজের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন। ওই এক সপ্তাহ ফুটবল থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর সুফলও দেখা গিয়েছিল অচিরেই। ওই বছরই শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানকে হারিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। তা-ও একটি দু’টি নয়, পাঁচ-পাঁচটি গোলের ব্যবধানে। আর সেই পাঁচ গোলের প্রথমটি এসেছিল সুরজিতের পা থেকেই। আর সেই ম্যাচের দিন প্রবল জ্বরে কাবু ছিলেন সুরজিৎ। সেই অবস্থাতেও মাঠে নেমেছিলেন।
এবার সুভাষ ভৌমিকের উদ্যোগে জর্জ টেলিগ্রাফের জার্সি গায়ে মাঠে নামলেন সুরজিৎ। উল্টোদিকে এরিয়ান্সের রক্ষণভাগ সামলাচ্ছেন আর এক বাঘা খেলোয়ার সত্যজিৎ ঘোষ। কাজেই লড়াই খুবই কঠিন। জর্জের তাঁবু থেকে দলের অনান্যদের সঙ্গে সুরজিৎ হেঁটে এলেন ইষ্টবেঙ্গল মাঠে। তাঁকে দেখে জর্জের টিমের পিছনে জনতার ভিড় ক্রমশই বাড়ছে। নিরুত্তাপ সুরজিৎ ড্রেস করার পর থাই এর পেশিগুলিকে নিজের হাতেই ম্যাসাজ করলেন। তখন তাঁকে দেখে মনেই হচ্ছিল না এই ফুটবলারটির আকর্ষণেই এককালে ময়দান ভরে উঠত কানায় কানায়। বরং তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল ময়দানে সদ্য খেলা শুরু করা কোনও তরুণ ফুটবলার। যিনি নিজেকে প্রমাণ করতে চান।
সুরজিতের দ্বিতীয় পর্বের সেই খেলাতেও দেখ গেল সেই একই রকমের জেদ। জর্জ টেলিগ্রাফ সেদিন এক গোলে পিছিয়ে। সেই অবস্থায় তাঁর নেওয়া একটি ফ্রি-কিক সামান্যের জন্য বারের উপর দিয়ে চলে গেল। এমন সুযোগ নষ্টের গ্লানি ভুলতেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই জ্বলে উঠলেন সুরজিৎ। এক সময় এরিয়ান্সের রক্ষণ ভাগে বল ক্লিয়ার করতে গড়িমসি করছিলেন সত্যজিৎ ঘোষ। মুহূর্তে সেই বল কেড়ে নিলেন সুরজিৎ। আর তারপর ডান পায়ের নিখুঁত প্লেসিংয়ে বল জড়িয়ে দিলেন প্রতিপক্ষের জালে।
মনে আছে, বিরতিতে জর্জ টেলিগ্রাফের খেলোয়াড়দের তাতাতে কোচ সুভাষ ভৌমিক বলেছিলেন, ‘আরে এই বুড়োটা এখনও লড়ে যাচ্ছে। ডিফেন্ডারদের থেকে বল কেড়ে নিয়ে গোল করে আসছে। তোরা কি এই লড়াই থেকে কিছুই শিখবি না?’
পরের পর্বে শোনাবো সুরজিতের জীবনের সেরা গোল আর ফুটবলে বিদ্রোহের কথা।
(ক্রমশ)

অলংকরণ- রাতুল চন্দরায়